‘মাটির জাহাজ’ উপন্যাসে গুটিকয় চরিত্রের সহজিয়া গল্পকথার ঠাসবুনটে ফুটে উঠেছে জীবন ও সমাজের অন্তর্চ্ছবি। আঞ্চলিক ভাষার ঝলমলে রূপাবলি মেলে ধরে গভীর এক নিরীক্ষার পরিচয় রেখেছেন মাহমুদুল হক আপাতসরল কাহিনী ধারার অন্তরালে। সমাজের গহীন অন্ধকারে আটকে-পড়া মানুষের গাঁথা রচনা করেছেন তিনি এই উপন্যাসে। জয়নাল, মনোহর আর দুঃখবতী নারীরা হয়ে উঠেছে এ-কালের নিষ্ঠুর রূপকথার পাত্রপাত্রী।
Mahmudul Haque (Bangla: মাহমুদুল হক) was a contemporary novelist in Bangla literature. He was born in Barasat in West Bengal. His family moved to Dhaka after the partition in 1947. His novels deal with this pain of leaving one's home.
Mahmud gave up writing in 1982 after a number of acclaimed novels. Affectionately known as Botu Bhai and always seen as a lively figure in social gatherings, the rest of the time he was said to lead a solitary life.
মাহমুদুল হকের লেখা পড়লে মনে হয় যেন কবিতা পড়ছি। এমন এক গদ্যভাষা ভদ্রলোক আয়ত্ত করে গেছেন যে স্রেফ লেখনীর জোরে পাঠক পাতা উল্টে যায়, গল্পে কী ঘটছে না ঘটছে সে ব্যাপারে খুব বেশি মাথা না ঘামিয়ে। বাংলা ভাষা যে কী পরিমাণ কাব্যিক, জাদুময় ও ঘোরলাগানো তা যে কয়জন সাহিত্যিক হাতেকলমে প্রমাণ দিয়ে গেছেন তার সবচেয়ে উপরের সারিতে মাহমুদুল হকের নাম থাকবে।
একজন নারী ব্যাবসায়ী জয়নাল ও একজন দালাল মনোহর কে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাস। নতুন মেয়ের খোজে গ্রামে এসেছে জয়নাল। মনোহর তাকে মেয়ে দেখতে নিয়ে চলেছে। তাদের দুজনের কথোপকথনটাই উপন্যাসের মূল ভিত্তি। তাদের কলুষিত জীবন ও জীবন যুদ্ধের ব্যাপারে দুজনের কথোপকথন প্রান দিয়ে উপন্যাসে। লেখক বেশ সাহসী ছিলেন পুরো উপন্যাসে। সমাজের এই কদর্য অধ্যায় নিয়ে বিন্দুমাত্র রাখঢাক এর মধ্যে যান নি। তার ভাষার ব্যাবহার অসাধারন। উপন্যাস নিতান্ত ক্ষীণতনু হলেও, ভাষার গাথুনী বেশ ভারী করে তুলেছে।
"ঘাটের কাছেই ক্যাম্প বসেছে রক্ষীদের, শুনেছে আগেই। সন্ধের পরেই আর ঘর থেকে কেউ বেরোয় না, গুম-খুন, ডাকাতি, গোলাগুলির ঝামেলায় অবস্থাপন্নদের অনেকেই এখন গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে চাক বেঁধেছে।... কাউকে তেমন সন্দেহজনক মনে হলে সোজা ক্যাম্পে ভরা হয়, তারপর যার নাম আখছেলাই, আখমাড়াই।"
১৯৭৭ সালে রচিত মাহমুদুল হকের বই 'মাটির জাহাজ।' এই উপন্যাসকে বোঝার জন্য সময়কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবন আমার বোন উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের আগের। আর মাটির জাহাজ পরবর্তী সময়কালের। জীবন আমার বোনে মূল চরিত্র খোকার যে আশংকা থাকে মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে তাই বাস্তব হয়ে উঠলো মাটির জাহাজে। আর লেখক বেশ সাহসের সাথে তা তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে।
পোলিশ চলচ্চিত্রকার ক্রিস্তফ জানুসি বলেছিলেন, "সীমান্ত জিনিসটা পুরোপুরি কৃত্রিম। তা মানুষের তৈরি এবং বিতর্কযোগ্য। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ বিতর্কের পরিসমাপ্তি হয় যুদ্ধে, যা কোনো সমাধান নয়।" এই উপন্যাসকে বোঝার জন্য উপযুক্ত মন্তব্য এটি।
নারী ব্যবসায়ী জয়নাল ও একজন দালাল মনোহরের কথোপকথন ঘিরে রচিত হয় পুরো উপন্যাস। এদের মধ্যে জয়নাল নতুন মেয়ের খোঁজে গ্রামে এসেছে। সমাজের নানা অমানবিকতাকে লেখক তুলে ধরেন নিপুন হাতে। আর ফুটে উঠতে থাকে মানুষের মাঝে বাস করা কুটিল বাস্তবতা, ব্যক্তিমানুষের দ্বন্দ্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ , নিজস্ব একাকীত্ব।
মাটির জাহাজের ব্যাপ্তি কম, লেখকের অন্য লেখার মত শক্তিশালী না হলেও, শব্দ বিন্যাস আমাকে মুগ্ধ করেছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে রয়েছে অসংখ্য চরিত্র, রয়েছে অনেক রকমের ভাষা। মূলত বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষার ব্যবহার বেশি হলেও এক জয়নালকেই বলতে শোনা যায় নানা ঢঙে নানা অঞ্চলের ভাষা।
অনেক গুলো চরিত্র, লেখক একটার পরে একটাকে সাজিয়েছেন দক্ষ চিত্রকরের মত। চরিত্র গুলো প্রকাশ করেছেন তাঁদের ভয় আর সংশয়ের কথা।
এই লেখাটি পড়েও মাহমুদুল হকের প্রতি আমার মুগ্ধতা অটুটই রইলো।
মাহমুদুল হকের লেখা পড়লে মনে হয় গদ্যের চেহারায় পদ্যের ঝঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁর প্রায় সব লেখাতেই এই বৈশিষ্ট্য প্রবল। পাঠককে গল্পের শেষ পর্যন্ত আটকে রেখে মুগ্ধতার রেশ ছুঁয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর আওয়ামিলীগ প্রশাসন রক্ষীবাহিনী দিয়ে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করে। তখন অনেক বামপন্থী দল চরমপন্থা বেছে নেয় এবং দিনে দুপুরে মানুষ হত্যা শুরু করে। গ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন দলের সশস্ত্র টহল চলতো। সবাইকেই চাঁদা দিতে হতো। না হলে ঘাড়ের উপর মাথা রাখার নিশ্চয়তা ছিল না। এমনই এক উত্তাল সময়ে মনোহর মাঝির নৌকায় জয়নাল ঢাকা থেকে আসে। মনোহর একজন চা দোকানদার। তবে তার আরেকটা পরিচয় আছে; সে মানুষের ব্যবসা করে। মেয়ে মানুষের ব্যবসা। জয়নালের কাছে গল্প করেছিল জীবন ঢালীর মেয়ে কুসুমের। সেই কুসুমকেই জয়নালের লেদার বিজনেস(নারীর ব্যবসা) এর নতুন কাঁচামাল হিসেবে নেওয়ার বুদ্ধি করে গ্রামে আসে। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ তখন ভিন্নরূপ। কুসুমের নাগাল না পেলে তারা নতুন মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। দেখাইবিবি বিভিন্ন জায়গার এতিম মেয়েদের নিজের কাছে আশ্রয় দেয় এবং সুযোগমতো বিক্রি করে দেয় জয়নালের মতো কোনো দালালের কাছে। কিন্তু আজ আর সেখানে গিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়েকে তারা জোগাড় করতে পারেনা। ফিরতি পথ ধরতে হয় তাদের। বোলতলীর নাদেরালির থেকে পাওয়া যায় হেনাকে। হেনাকে নিয়ে আসার সময় জোর করেই চুমু দিতে চায় জয়নাল। তখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে হেনা। আচমকা গোপন বাহিনীর এক নৌকা তাদের নৌকার গতি রোধ করে। তাহলে কি বেঘোরে মারা পড়বে জয়নাল ও মনোহর?
ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উপন্যাস। সংশয়ের দিনগুলিতে রাস্তায় চলাফেরা করতে হলেও অনেক দিক বিবেচনা করতে হতো। কখন না আবার কোন বাহিনীর খপ্পরে পড়ে পিতৃপ্রদত্ত জীবনটা খুইয়ে দিতে হয়! একইসাথে একজন মানুষ ব্যবসায়ীর চিন্তার জাল বিস্তৃত হয়েছে উপন্যাসটিতে। হ্যাপি রিডিং।
অল্পএকটু সময়, হাতেগোনা কয়েকটা চরিত্র নিয়েই "মাটির জাহাজ" উপন্যাস। এর অল্প সময় আর হাতেগোনা চরিত্র নিয়েই ফুটে উঠেছে একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি, সেই অঞ্চলের ভাষা, আঞ্চলিকতা ও সমাজচিত্র। সহজ সরল এক জীবনের ধারা তবুও কত জটিলতা, না পাওয়া আর ব্যথা বেদনা লেখকের লেখায় উঠে এসেছে।
মাহমুদুল হক এমন এক কারিগর যিনি শব্দের পর শব্দ গেঁথে রেকাবিতে জাদুর পানীয় প্রস্তুত করেন।শহীদ কাদরীর ভাষ্যমতে,অতিরিক্ত "গয়নাগাটি" পরানোর দোষে দুষ্ট হকের রচনা,কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এই "গয়নাগাটি" মাহমুদুল হকের সিগনেচার বৈশিষ্ট্য যা তাকে অন্যদের থেকে ভিন্ন করে তুলেছে। ১৯৭৭ সালে রচিত "মাটির জাহাজ" এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে নারী ব্যবসায়ী জয়নাল এবং তার দালাল মনোহর কে কেন্দ্র করে।জয়নাল জানে পাপকে ঘিরেই তার বসবাস,এজন্য সামান্য অনুশোচনা যে তার হয়না,তেমন নয়,কিন্তু রক্তে মিশে যাওয়া ব্যবসা সে ছাড়তে পারেনা। গ্রামে গঞ্জে,কোণায় কোণায় ঘুরে সে সংগ্রহ করে কালীগঞ্জের আলমাছিবিবিকে,অথবা দেখাইবিবির সখী অথবা দেহাতি গড়নের হেনাকে।এরা সকলেই ক্রীত বা বিক্রিত হয় একাধিকবার,মালিকানা বদলের পাশাপাশি বদল হয় রঙ,রূপ,পরিচয়।দিনশেষে নিতান্ত জৈবিক তাড়না মিটানোর জন্য হেনারা বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে,হতেই থাকে। জয়নালদের পাপের শাস্তি এতটুকুই-পালিয়ে বাঁচা জীবন তাদের।রক���ষীবাহিনী থেকে পালানো,নৌকায় বেরধক মার খাওয়ার পরেও জয়নালরা অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। ছোট পরিসরে সাজানো উপন্যাসটি হয়ত মাহমুদুল হকের অ���্য উপন্যাসের মত প্রকৃতির বিন্দু বিন্দু বর্ণনা দিতে অক্ষম,কিন্তু "মাটির জাহাজ" পরিচয় করিয়ে দেবে অনেকগুলো চরিত্রের সাথে,এমনকি সখীর সাথেও যে নিতান্ত শিশু এবং কিশোরীর বয়সের মাঝে আটকে পরা এক চরিত্র যাকে জোর করে সমাজ নারী হতে বাধ্য করেছে। মাহমুদুল হকের "গয়নাগাটি" চমক লাগাতে বাধ্য।
মাহমুদুল হক মানেই বড়ই আজিব কিসিমের জিনিসপাতি। এই ব্যক্তির লেখার মাঝে উপমা, রূপক আর বাক্যজালের গাঁথুনির ফাঁদে পড়লে মনে আসে, নির্ঘাত অন্যকোনো দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছি।
"মাটির জাহাজ" - এর কথাই ধরেন না। লেদার ব্যবসায়ী (পড়ুন, নারী ব্যবসায়ী) জয়নালের কথাই চিন্তা করেন। ব্যাটার পেটে বোম মারলেও দুই পয়সার বিদ্যা বের হবে না। অবাক কান্ড, সেই জয়নাল ই লঞ্চঘাটে মনোহরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার মাথায় আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন। তারই দার্শনিক বর্ণনা দেয় জয়নাল। এ বর্ণনায় উচ্চমার্গের কচকচানি নেই,অথচ বেশ উচ্চমার্গ আছে!
মনোহর নৌকোর মাঝি যোগ চা বিক্রেতা এবং জয়নালের হয়ে মেয়ে জোগাড়কারীও বটে। জয়নাল মনোহরের গ্রামে এসেছে কুসুম নামে এক মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে যেতে। যেখানে আছে তার বিয়ে না করেও বউ আলমাগাছি। আছে দেহব্যবসার দালালি।
মাহমুদুল হকের "জীবন আমার বোন " কিংবা "প্রতিদিন একটি রুমাল " এর মতো আশ্চর্য লেখনী হয়তো নেই; কিন্তু সেই কলম নিয়ে মাহমুদুল হক আছেন জয়নাল, মনোহর, আলমাগাছি,কুসুম আর হেনার মাঝে। আর হেনার জন্য শেষটায় কেমন যেন লাগে.....
একটি উপন্যাসে যাপিত জীবনের কতটুকু উঠে আসে? সফল উপন্যাসে জীবনের ঘরে দৃশ্যমান দৃশ্যের পাশাপাশি অদৃশ্য দৃশ্যগুলো ও উঠে আসে, ঘটনার অন্তরালে ঘটনাও হয়তো উঠে আসে কিন্তু সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের চলমান ভাষা কতটুকু উঠে আসে? না আঞ্চলিক ভাষার কথা বলা হচ্ছে না, বলছি চিন্তা আর কর্ম থেকে যে ভাষা মুখে প্রসারিত হয় তার কথা। চায়ের দোকানে কাজ করা একজন মানুষের ভাষা যেমন হবে একি সমাজে একজন শিক্ষকের ভাষা কিংবা দিন মুজুরের ভাষা কি এক হবে? না, কখনো এক হবে না, হয় না। যতই তারা একই মানচিত্রে বাস করুক, জীবন যাপনের মানের পার্থক্যের সাথে তাদের ভাষার পার্থক্য সূচিত হয়। এই পার্থক্য সূচিত হয় আসলে কর্ম দিয়ে। কর্মই ঠিক করে দেয় চেতনা-বোধ-বিশ্বাস-অবিশ্বাস। সেই কর্মের বঞ্চনা দিয়ে, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের হতাশা দিয়ে আর কখনো কখনো আশাবাদ দিয়ে মানুষের মুখের ভাষা রচিত হয়। তাহলে এ কথা সহজে বলা যায় কর্ম/পেশাই মানুষের ভাষা অনেকটা ঠিক করে দেয়। ভাষা বলতে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম বিবেচনা করছি না। ভাষা বলতে চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-কল্পনা, আশা-হতাশা, বাস্তব-পরাবাস্তব সবকিছুর প্রকাশ বুঝাতে চাইছি।
ভাষা নিয়ে বোধহয় লম্বা একটা ভূমিকা টেনে ফেললাম? যাইহোক টেনে যখন ফেলেছি তখন তার কারণটাও বলতে হয়। দীর্ঘায়িত ভূমিকার পরে মূল বক্তব্য সংক্ষেপেই আলোচনা করবো। আসলে একটি লেখা, হোক সেটি গল্প, হোক সেটি উপন্যাস, নানা ভাবে সেটি পাঠক হৃদয়ে ভালোলাগার সৃষ্টি করতে পারে। পটভূমি, গল্পের গাঁথুনি, নির্মাণ-শৈলী, শক্তিশালী চরিত্রয়ান, উপামা উপাখ্যান সহ নানান বিষয়। সব বৈশিষ্ট থাকার পরও কিছু লেখা পড়ে ব্যাক্তিগতভাবে আমি কোথায় জানি একটা অপূর্ণতায় ভুগেছি, মনে হয়েছে কি যেন নেই! হ্যাঁ সেগুলোর ’ভাষা’ আমাকে ছুঁয়ে যায়নি। তাই প্রিয় থেকে খুব বেশি প্রিয়তম হয়ে ওঠেনি লেখাগুলো। কিন্তু মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস সেই অপূর্ণতা ঢেকে দিয়েছে বিস্ময়কর ভাবে। দুই-চারটি চরিত্র আর অল্পকটি দৃশ্যপটের মাঝেই যে চিত্র এঁকেছেন মাহমুদুল হক তাতে মুগ্ধ হয়েই বলতে পারি ’মাটির জাহাজ’ অসামান্য এক উপন্যাস।
প্রকৃতপক্ষে জয়নাল আর মনোহর এই দুজনের কথপোকথনের মধ্য দিয়েই ’মাটির জাহাজে’ রচিত হয়েছে আমাদের সমাজের অন্ধকারে থাকা দৃশ্যগুলোর ভেতরের গল্প। যে অন্ধকারের গল্প আমাদের অজনা, অচেনা থেকে যায়। গল্প-উপন্যাসেও এটিকে সচেতন ভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে আমাদের বড় বড় সাহিত্যিক-রা। কিন্তু মাহমুদুল হক সেই অন্ধকারেই আলো ধরেছেন, অন্ধকারের ভেতরের নানান বঞ্চনা, হতাশা, ক্ষোভ, স্বপ্ন আর যাপিত জীবন নিয়েই রচনা করেছেন উপন্যাস ’মাটির জাহাজ’। যে উপন্যাসে জয়নাল একজন ব্যবসায়ী, নারী ব্যবসায়ী। নানান জায়গা থেকে নারী নিয়ে এসে ভাড়া বাড়ীতে মনোরঞ্জন করে উচুঁতলার মানুষ থেকে নিচুতলার মানুুষদের। কিভাবে কোন কৌশলে তাদের নিয়ে আসে, কত বঞ্চনা আর ছলচাতুরির আশ্রয়ে গড়ে তুলে নিজের সম্রাজ্য তার কথন’ই ’মাটির জাহাজের’ গল্প। বঙ্গদেশের নিয়ম মাফিক সেই ব্যবসায় ভাগ বসাতে চলে আসে পুলিশ, নেতা, মাস্তান, সমাজপতি সহ নানান শক্তিশালী মানুষগুলো। এ ছাড়াও থাকে সেই ব্যবসার আন্ত:প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্ব, হেরে যাওয়ার হতাশার গল্পই উঠে এসেছে’মাটির জাহাজে’। এবং রচিত হয়েছে তাদের ভাষাতেই, যে ভাষাতে জয়নালদের মতো মানুষরা কথা বলে। যেমন মনোহরের সাথে জয়নাল নির্লীপ্ত ভঙ্গিতেই বলছে..
’সুখে শান্তিবে বিজনেস করবো, সে উপায় নেই। আজন্মা বেজন্মা বেকার, কুলাঙ্গার, কি করে খাবে এখন। তৈরি করো ক্লাব, রাতারাতি হাজার গুন্ডা ক্লাব মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে অানাচে-কানাচে। মাথার খোল হুঁকো হয়ে যাচ্ছে, পাছার গোশ বুকে চ’ড়ে যাচ্ছে, বুদ্ধিসুদ্ধি হাঁটুতে নেমে যাচ্ছে। এখন ক্লাব পোষো, টাউট পোষো, কোন আত্নীয় পুলিশের চাকরিতে আছে তাকে খুঁজে বের করো, মেম্বার ধরো, সরদার ধরো। বিনে পয়সায় মাগীবাজী করতে হলে কি লাগে, সেরফ একটা হেউ। আগে দুশোটাকার জায়গায় তিনশ টাকা দিলে বাড়িওলা খুশি থাকতো। বলতো লোহার বিজনেস যা, লেদার বিজনেস ও তাই।, সবই বিজনেস, আমি বিজনেসম্যানকে ভাড়া দিয়েছি। এখন দুশোর জায়গায় বারশ দিলেও তাদের গায়ের জ্বর একশ পাঁচ থেকে আর নামে না। তারউপর অগ্রিম বলে একটা কথা আছে। জগতে তিনিই ভালো মানুষ, হালালের টাকা দিয়ে তিনি বাড়ি করেছেন, তুমি শালা চোর, কেননা তোমার শালা কিছুই নেই, তিনি যা বলবেন তোমাকে তাই করতে হবে। লেদার বিজনেস তো দূরের কথা, নিজের পরিবার কে নিয়ে চৌকিতে শোয়াও অপরাধ, মটমট শব্দ হলে যদি বাড়ির ক্ষতি হয়। তুমি বাপু অন্য বাড়ি দেখো। তার মানে এসো আর যাও। ঢোকো আর বেরহও, উনি দেখে নয়ন সুখ করবেন। কেননা বেরুলেই আবার দুশো বাড়াতে পারবেন। মুতে দেই এমন বাড়উলিগিরি মুখে।’
এভাবেই কোন রাখঢাক থাকে না জয়নালদের ভাষাতে, কর্ম থেকেই যেখানে ভাষার জন্ম মননে এবং চিন্তার জগতে আর যোগাযোগের ��াধ্যম হয়ে প্রতিস্থাপিত হয় ওষ্ঠে। সেই ভাষার তীক্ষ্ণতা আমাদের মতো নিরিবিচ্ছিন্ন আয়েশী জীবন যাপন কারীদের আঘাত দেয় গভীর বিশ্বাসে, বোধের শুদ্ধতম চেতানাতে। ’মাটির জাহাজ’ সেই বোধের জগতের অদেখা গভীরে আলো ফেলে, সমাজের গহীন অন্ধকারে আটকে পড়া মানুষদের জীবনের নানান দিকের গল্প বলে যায় অকপটে। ছোট্ট অথচ বিষয় বৈচিত্র্যতা, গল্পের গভীরতায় আর ভাষার গাথুঁনি এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের উজ��জ্বল রচণা হিসেবে চিন্থিত হবে বলেই আশা করি।
জয়নাল। ঢাকার এক ভাড়াবাড়িতে নারী নিয়ে ব্যবসা করে। সারাদেশ থেকে ছোট ছোট মেয়ে সংগ্রহ করে 'কালেমা পড়ে বিয়ে না করা বউ' আলমাছি বিবির হাতে দেয় সে। বাকি কাজ আর তাকে করতে হয় না। অল্পদিনেই ব্যবসার উপযোগী ট্রেনিং পেয়ে যায় মেয়েগুলো। সারাদেশ থেকে মেয়ে সংগ্রহের জন্য তার রয়েছে বেশ কিছু দালাল। তেমনই এক দালাল মনোহর। এমনই এক সংগ্রহ অভিযানে মনোহরদের এলাকায় জয়নালোর যাত্রা নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি। কিভাবে তারা ব্যবসা চালায়, মেয়ে সংগ্রহ করে, কেন তাদের এই ব্যবসা, তাদের ভবিষ্যৎ এসবই ধীরে ধীরে নাটকের ভঙ্গিতে সংলাপাকারে উঠে আসে উপন্যাসটিতে।
এককথায় বললে অসাধারন। এত ছোট পরিসরে একটি সময়কালের (স্বাধীনতা পরবর্তী) একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের গল্প তুলে ধরেছেন তা সত্যিই অনবদ্য। অতি অল্প কিছু চরিত্র যাদের বেশিরভাগই পরিণত নয় : কিছু ব্যবসায়ী, কিছুু দালাল, কিছু যোগানদাতা আর নিপড়িত কিছু মেয়ের মাধ্যমে সেইসময়ের কুটিল বাস্তবতা, ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতার গল্প বলা খুব বড় মাপের সাহিত্যকেরই পরিচয়। নিজের অসাধারন বর্ণনাভঙ্গি দিয়ে অন্ত্যজ শ্রেণির কথা বলেছেন দরদি ভাষায়। আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগটা ছিল যথার্থ। লেখক যেন এই সমাজেরই একজন তাই তাদের ভাষার মাধ্যমে তাদের সমাজ, বিশ্বাস, চেতনাকে তুলে ধরেছেন সহজভাবে।
সময়কালকেও ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্যভাবে : স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের সমাজ ব্যবস্থা, রক্ষীবাহিনী, চিরকালীন পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনির কথা এসেছে সহজভাবে। লেখকের ব্যক্তিগত জীবনটাও রহস্যময়। অসাধারন লিখতে থাকাকালীন সময়েই রহস্যজনকভাবে লেখা বন্ধ করে দেন আশির দশকে (মৃত্য ২০০৮)। বেশ কিছু সম্ভাব্য কারন থাকলেও সুফিজগতের প্রতি আগ্রহকেই এর জন্য কারন বলে মনে করা হয়। 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে আর কারো লেখার কিছু নাই' অনেক সাহিত্যিকের মত বিশ্বাস করা এই লেখকের সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'তাঁর বাংলা সাহিত্যে বাদশাহী করার ক্ষমতা আছে'। তো অসাধারন পান্ডিত্যের অধিকারী রহস্যময় এই লেখকের অসাধারন ভাষায় রচিত অন্ত্যজ শ্রেণির এক সহজিয়া বর্ণনা পড়তে পড়ে ফেলুন বইটা।
মাহমুদুল হক'কে নিয়ে আমার বিস্ময়ের ঘোর লেগেই থাকে। যেমন এই উপন্যাসে তিনি আবার আমাকে চমকে দিলেন। দেহোপজীবিনীর এক দালালকে ঘিরে এই উপন্যাস রচিত। পড়তে পড়তে বারবার একটা জিনিসটা মনে হচ্ছিলো, একজন মানুষ কীভাবে এত সুন্দর করে একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারে! অবাক করে দেয় আমাকে। মনে হচ্ছিলো এই উপন্যাসের চরিত্র জয়নাল কোন চরিত্র নয়, বরং একজন জ্যন্ত মানুষ। যে দালালি পেশায় যুক্ত এবং তিনি তার দিনলিপি আমাদের শোনাচ্ছেন। অদ্ভুত, অসাধারণ… পড়তে পড়তে আবার ভাবতে হয়, মাহমুদুল হক কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। রেটিং - ৪.৫/৫
মাহমুদুল হকের লেখার প্রতি মুগ্ধতা অটুট রইলো ।প্রান্তিক জীবনের যে দৃশ্যগুলো আপাত কদর্য এবং অমানবিক বলে মনে হয় এবং অমানবিক বলেই হয়তো সেগুলোকে অস্বীকার করার কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে , ভাষিক কারুকাজ আর বাহুল্যবর্জিত চিত্রায়নের মাধ্যমে সেই দৃশ্যগুলোকে জোড়া দিয়ে দিয়ে মাহমুদুল হকের এই উপন্যাস । তবু সমাজের কুটিল বাস্তবতা , নিম্নবিত্ত সমাজের ভেতরেই গড়ে ওঠা আরও আরও উপশ্রেণী - এসব বাস্তবতা ছাড়িয়ে উপন্যাসে ফুটে উঠেছে ব্যক্তিমানুষের দ্বন্দ্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ , নিজস্ব একাকীত্ব । প্রধানত জয়নাল এবং মনোহর এই উপন্যাসের কথোপকথোন চালিয়ে নেওয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও , কোন নির্দিষ্ট চরিত্রের প্রতি লেখকের ছিল না পক্ষপাতিত্ব , ছিল না 'মানবিক সমাপ্তি ' নামের অলীক কোন উপসংহারের দিকে যাত্রা । কুসুম মেয়েটি যখন ' মা -অমা-মায়ো ' বলে ডুকরে ওঠে , তখন জয়নাল বলে , 'এই নাকি আবার একটা কথা , ভপ ! ' এই সংলাপের মাধ্যমে উপন্যাসের ব্যাপ্তিতে শেষের দিকে পাঠকের মনে জয়নাল সম্পর্কে যে কিছুটা আদর্শ এবং মানবিক রূপ কল্পিত হয়েছিল , তা পুনরায় নিঃস্পৃহতায় পরিণত হয় । এবং পুরো বইয়ের চরিত্রগুলো , প্রাকৃতিক দৃশ্যের ঘটনা সংশ্লিষ্ট বর্ণনা , সংলাপের স্বার্থপরতা , সবকিছুই যার যার জায়গায় অটুট থাকে ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের জীবন কেমন ছিল? তাদের জীবিকা? আচ্ছা, ঐ সময়ে গ্রাম বাংলার নারীদের অবস্থা? একজন Pimp, সোজা বাংলায় দালাল-এর জীবন কি থেমে ছিল? বেশ্যা বা পতিতাদের? পেটের দায় কি কখনো থেমে থাকে?
থাকেনা। জীবন বহমান। চারিপাশে যাই ঘটুক না কেন জীবন চলতেই থাকবে।