আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম লেখকরূপে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর কীর্তি ও অবদান অপরিমেয়। এই বরেণ্য স্রষ্টা যখন তাঁর নিজের জীবনের কথা লিখতে শুরু করলেন তখন পাঠক মহলে নানা জিজ্ঞাসা ও আলোড়ন উঠেছিল। সাময়িকপত্রে ধারাবাহিক প্রকাশের সময় তিনি লিখেছিলেন, ‘নিজের জীবনকাহিনী আমি লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি কেন? না লেখারই বা কী আছে! আত্মজীবনী তো শুধু মহাপুরুষ বা মহাকবিরাই লেখেন না, অবসরপ্রাপ্ত সেনানী বা ছারপোকাও লেখে।’ ‘অর্ধেক জীবন’ নিয়ে তখন বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের ভিতর যে-কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। অনেকে ভেবেছিলেন, এক দীর্ঘ ব্যাপ্ত সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজের জীবনকাহিনী চিত্রিত করবেন লেখক। কিন্তু আদপে তা হয়নি। ‘অর্ধেক জীবন’-কে পুরোপুরি আত্মজীবনী বলা যায় না, আবার নিবিড় অন্তর্জীবনের অনুপুঙ্খ ইতিহাসও নয়। বরং এই দুইয়ের মাঝামাঝি এক আশ্চর্য জীবনগাথা। নিজের জীবনকে যিনি তাঁর বিস্তর কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে টুকরো টুকরো ব্যবহার করেছেন, তিনিই যেন এক পূর্বপরিকল্পিত নির্দিষ্ট পরিধিতে ধরতে চেয়েছেন তাঁর বাল্যকাল থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত বয়েসকে। পূর্ববাংলার এক অখ্যাত গ্রামে লেখকের জন্ম। আবার বহু বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্যাত্রা। জীবনের এই কালসীমা ঠিক যেন একটি বৃত্ত। এই বৃত্তবর্তী জীবনকাহিনী ‘অর্ধেক জীবন’-এর প্রধান উপজীব্য। লেখকের নিজের ভাষায়, ‘...চল্লিশ-পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিপদসঙ্কুল, কঠিন, ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন টিকিয়ে রাখা, যাকে বলে জীবনসংগ্রাম, সবকিছুই অনিশ্চিত, তারই মধ্যে নানারকম আশা, আকাঙক্ষা ও ভালোবাসা, অনেক স্বপ্ন, সেই বয়েসটার কথা লিখতে চেয়েছি।’ তিনটি দশক জুড়ে লেখকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-ভালবাসা, স্মৃতি-বিস্মৃতি, অনতিঅতীতের ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনার ইতিবৃত্ত এই রচনাকে অন্যমাত্রায় উত্তীর্ণ করেছে। সব মিলিয়ে ‘অর্ধেক জীবন’ একটি রোমাঞ্চকর, সংগ্রামবহুল, গৌরবময় ও আনন্দ-বেদনায় আকীর্ণ সত্যিকারের জীবনকাহিনী।
Sunil Gangopadhyay (Bengali: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) was a famous Indian poet and novelist. Born in Faridpur, Bangladesh, Gangopadhyay obtained his Master's degree in Bengali from the University of Calcutta, In 1953 he started a Bengali poetry magazine Krittibas. Later he wrote for many different publications.
Ganguly created the Bengali fictional character Kakababu and wrote a series of novels on this character which became significant in Indian children's literature. He received Sahitya Academy award in 1985 for his novel Those Days (সেই সময়). Gangopadhyay used the pen names Nil Lohit, Sanatan Pathak, and Nil Upadhyay.
Works: Author of well over 200 books, Sunil was a prolific writer who has excelled in different genres but declares poetry to be his "first love". His Nikhilesh and Neera series of poems (some of which have been translated as For You, Neera and Murmur in the Woods) have been extremely popular.
As in poetry, Sunil was known for his unique style in prose. His first novel was Atmaprakash (আত্মপ্রকাশ) and it was also the first writing from a new comer in literature published in the prestigious magazine- Desh (1965).The novel had inspiration from ' On the road' by Jack Kerouac. His historical fiction Sei Somoy (translated into English by Aruna Chakravorty as Those Days) received the Indian Sahitya Academy award in 1985. Shei Somoy continues to be a best seller more than two decade after its first publication. The same is true for Prothom Alo (প্রথম আলো, also translated recently by Aruna Chakravorty as First Light), another best selling historical fiction and Purbo-Paschim (পূর্ব-পশ্চিম, translated as East-West) a raw depiction of the partition and its aftermath seen through the eyes of three generations of Bengalis in West Bengal, Bangladesh and elsewhere. He is also the winner of the Bankim Puraskar (1982), and the Ananda Puraskar (twice, in 1972 and 1989).
Sunil wrote in many other genres including travelogues, children's fiction, short stories, features, and essays. Though he wrote all types of children's fiction, one character created by him that stands out above the rest, was Kakababu, the crippled adventurer, accompanied by his Teenager nephew Santu, and his friend Jojo. Since 1974, Sunil Gangopadhyay wrote over 35 novels of this wildly popular series.
Death: Sunil Gangopadhyay died at 2:05 AM on 23 October 2012 at his South Kolkata residence, following a heart attack. He was suffering from prostate cancer for some time and went to Mumbai for treatment. Gangopadhyay's body was cremated on 25 October at Keoratola crematorium, Kolkata.
Awards & Honours: He was honored with Ananda Award (1972, 1979) and Sahitya Academy Award (1984).
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক। তার উপন্যাস যেমন আমায় ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়, ঠিক তেমন করে তাঁর জীবনীও সমানভাবে আমায় টানে। বলতে গেলে তাঁর জীবনটাও একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের চেয়ে কম নয়।
আগে অনেক বই থেকে টুকরো টুকরোভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রোমাঞ্চকর জীবনের পরিচয় পেয়েছি। সবসময় তাঁর জাদুকরী লেখনীতে সেসব অপূর্ব লেগেছে। কিছুক্ষেত্রে একই কথা একই ঘটনাগুলো বার বার ভিন্ন ভিন্ন বইয়ে আসা সত্ত্বেও কখনো বিরক্তি আসেনি পড়ার ক্ষেত্রে। তবে বরাবর তাঁর ছোটবেলার জীবন, তাঁর পূর্ববঙ্গের স্মৃতি, বেড়ে উঠা নিয়ে আগ্রহ ছিল। কিছু কিছু লেখায় অল্পবিস্তর আভাস পেলেও, এই বইটায় তাঁর জীবনের প্রথমাংশের স্মৃতিগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে পারার সৌভাগ্য হয়েছে।
বর্তমানে পাঠক সমাজে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভক্ত অনেক'ই বলা চলে। যারা তাঁর গল্প-উপন্যাস, কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের জন্য ব্যক্তি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপেক্ষা করছে এই বইটায়।
অর্ধেক জীবন (হাফ দ্য লাইফ); পড়ে ফেললাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। সেখানে স্মৃতি কথার পাশাপাশি হাজির হয়েছে তৎকালীন আর্থসামাজিক অবস্থা, যুদ্ধ এবং লেখকের নৈতিকতা, মানুষের পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ এবং অযৌক্তিক সূত্রকে কেন্দ্র করে বাদানুবাদের খণ্ডচিত্র।
লেখক সুনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছেলেবেলায়। কখন কীভাবে ঠিক খেয়াল নেই তার দুই একটি গল্প পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই কাকাবাবু সিরিজের। ততদিনে সম্ভবত পঞ্চম কী ষষ্ঠ শ্রেণীতে পা রেখেছি, কাব্যচর্চায় আগ্রহ উঠতির দিকে। জীবনের প্রথম লেখাটিই ছিল কবিতা/ছড়া, তা ছাপা হয়েছিল স্কুল ম্যাগাজিনে। সিলেক্টর কমিটির আপা ছিলেন বাংলার শিক্ষিকা, তিনি কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করেছিলেন। না, ভাষ্য পরিবর্তন করেননি, অধিকাংশই যতি-চিহ্ন সম্পর্কিত পরিমার্জনা করেছিলেন। আমি তখন সবে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী, যতি-চিহ্নের গুরুত্ব বুঝি না! পরে কিছুটা বুঝেছিলাম। সেই সাফল্য থেকে লেখার প্রতি ঝোঁক। মাঝে মাঝে নৈশ-ভোজনের পর আনকোরা ডায়েরি নিয়ে বসে যেতাম পড়ার টেবিলে, মাথা গুঁজে লিখতাম কবিতা। বসলে বেশিক্ষণ লাগত না, ছন্দ মিলিয়ে বিচ্ছিরি হাতের লেখায় নাতিদীর্ঘ সেই কাব্য-কথন আমি ছাড়া খুব বেশি পাঠকের দেখার সুযোগ ছিল না। ঠিক এমন একটা সময় সুনীলের কাকাবাবু বইটি আমার হাতে আসে। আমি পড়ি। আরও কয়েকটি গল্প ছিল, কিন্তু কোনও কারণে ‘রাজবাড়ীর রহস্য’ শিরোনামের একটি গল্প বিশেষ ভাল লেগে যায়। এবং মনে হয় আমারও এই জাতীয় গল্প লেখা প্রয়োজন। সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর, রূপকথা পড়ুয়া পাঠকের সেই প্রথম গল্প লেখার চেষ্টা। স্পষ্ট স্মরণে আছে, লাল ঝিকিমিকি গ্লসি বাইন্ডিং-এর বামন-আকৃতির ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল সেই ভূতপূর্ব উপাখ্যান। পুরোটা লিখতে কয়েক দিন লেগেছিল। সমাপ্তির দাঁড়ি টানার পর পড়ে দেখি, একি! এ যে হুবাহু সুনীলের সেই গল্পই টুকে দেয়া হয়েছে! তাতে মৌলিকতার ছিটে ফোঁটাও নেই, উল্টে ভাষ্য এবং ঘটনাক্রমের অধঃপতন দৃশ্যমান। তখনকার মতো গল্প লেখার প্রয়াসে ইতি টেনেছিলাম। কিন্তু কাকাবাবু পড়া ছাড়তে পারিনি। ততদিনে বেরিয়ে গেছে কাকাবাবু সিরিজের বেশ কিছু বই। সেগুলো একত্র করে কিছু সমগ্রও মুক্তি পেয়েছে। একক বইগুলো পাওয়া যেত নিউমার্কেটের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে। তবে, তার দাম ছিল তুলনামূলক ভাবে বেশি, ইচ্ছা থাকলেও কেনার জন্য দাবি জানাতে সঙ্কোচ হতো। তাই স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ কাড়ে সমগ্রগুলো। এই সিরিজের দ্বিতীয় সমগ্রটি কোনও এক বন্ধুর থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, প্রতিটি গল্প অসাধারণ, আমি এক বসাতেই সুনীলের আজন্ম ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অকুতোভয় এক বীর বাঙালী, একটি পা ছাড়াই জীবনের পথে অভ্যস্ত, কাউকে ছেঁড়ে কথা বলেন না। ভাইপো সন্তুকে সঙ্গী করে পাড়ি দেন দুর্গম জঙ্গল, সুদৃঢ় পর্বতমালা, আদিবাসীদের দ্বীপ কিংবা বেপরোয়া শহরে। পরবর্তীতে অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি সেই ভালবাসাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রথম উপন্যাসটি অ্যাডভেঞ্চারধর্মী করার সিদ্ধান্ত নিতে।
এত কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না, তবু বললাম। ভাল কোনও লেখা পড়লে আমার মনে এক অদ্ভুত ক্রিয়া হয়, সেই জাতীয় কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। সুনীলের অর্ধেক জীবন উপন্যাসটি যেহেতু আত্মজৈবনিক সেহেতু কিছু স্মৃতিকথা রোমন্থনের লোভ ছাড়তে পারলাম না। তাছাড়া আমার জীবনে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে ভূমিকা রেখেছেন সে কথাও স্বীকার করা কর্তব্য বৈকি! ছেলেবেলার প্রিয় লেখকদের কথা মনে থাকে আজীবন, তারা যে মর্যাদার আসন দখল করে ফেলেন তা বোধকরি পূর্ণ যৌবন কিংবা বার্ধক্যের সীমানায় হানা দেয়া লেখকরা খুব সহজে করতে পারেন না।
যাক সে কথা।
অর্ধেক জীবন বইটি একটি সুলিখিত দলিল। রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের বুকে কোনওক্রমে বেঁচে থাকতে চাওয়া একটি মধ্যবিত্ত পরিবার, যার কর্তা একজন শিক্ষক। সেই পরিবারের বড় সন্তান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম লেখকের, সেখান থেকে ক্রমশ ভাগ্যের পাকচক্রে গিয়ে হাজির হওয়া ইংরেজ শাসিত কোলকাতার বুকে। (আমার লেখাটির পরবর্তী অংশে আছে বইয়ের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যারা কাহিনীর ছায়ারেখা জেনে ফেললে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন বলে মনে করছেন, তারা বাকিটা না পড়লেই সম্ভবত ভাল!)
এ যেন এক মধ্যবিত্তের লেখক হয়ে ওঠার গল্প, আমার চিন্তা ভাবনার সঙ্গে লেখক সুনীলের মতৈক্য। সাহিত্য অঙ্গনের বিবিধ বিষয়ে হানা দেয়ার প্রয়াস থেকে শুরু করে প্রগতি পর্যন্ত সমস্ত পরিক্রমা অন্তরে ভাষার সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করে দিয়েছেন লেখক। পড়তে পড়তে মাথা নেড়েছি, কিছু ক্ষেত্রে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, আনন্দে আবার হেসে ফেলেছি পরক্ষনেই। আবার ট্র্যাজেডির ঘটনাগুলোতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছি, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছি। লেখক যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসবেন কিনা এই চিন্তায় দিশেহারা তখনও নিজেকে খুঁজে পেয়েছি তার পাশেই। ক’দিন আগে তো আমিই ছিলাম তার স্থানে, তার ব্যাথা আর আশঙ্কা যে আমারও চির চেনা! সেই লেখক হতে চাইবার অদম্য বাসনা, স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে নির্দিষ্ট চাকুরীর দাসত্ব না করে কেবল লেখাকেই জীবিকার একমাত্র মাধ্যম করার যে প্রয়াস সুনীলের ছিল তা তো আমারও আছে! কিন্তু সুনীলের অনেক কিছুই আমার নেই- নেই তার মতো বই পড়ার একরোখা আগ্রহ, নেই তার মতো সর্বত্র ভ্রমণের বাসনা। আমি তার মত লঘু মাদকের আস্বাদ নিতেও অনিচ্ছুক, আড্ডায় সপ্রতিভ নই। তার জীবনে কোনও লেখা প্রত্যাখ্যাত হয়নি, আমার হয়েছে, একাধিক।
লেখক হতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের জীবন হয়তো আংশিক একই হয়! হয়তো সব পরিকল্পনা সফল হয় না। সুনীল কবি হতে চেয়ে হয়ে গেছেন গল্প-উপন্যাসের সাহিত্যিক (যদিও তাঁর কাব্য অবদান অসীম); ফ্রিল্যান্স লেখক হতে পারেননি দীর্ঘদিন চাকরি করতে হয়েছে তাকেও। আমার জীবনের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাবার বিষয়গুলোকে অনভিপ্রেত কাকতল বলে উড়িয়ে দিতে গিয়েও পারি না। পথ ভিন্ন হলেও আমাদের গন্তব্য এক। সেই গন্তব্যে যে যার মতো যতটুকু পৌঁছতে পারে তার সাফল্য ঠিক ততটুকু। ভিন্ন ভিন্ন পথে আগুয়ান পথিকদের অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে হেঁটে চলে ভিন্ন লক্ষ্যের দিকে। কেউ কেউ আবার মুখ থুবড়ে পড়ে আরাম্ভেই তারা সেই পথের অগণিত হণ্টকের মতো বিস্মৃত হয়ে যায় অনাগত ভবিষ্যত থেকে। যারা বেঁচে থাকে যারা চলতে পারে। সুনীল সেই সাহিত্য পথের এক নমস্য পথিক। তার হাঁটা অনেক নবীন লেখকের মনে প্রেরনার স্পন্দন হয়ে বাজবে বহুকাল- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এইটা এক বসায় শেষ করার মতন বই না। এটা পড়তে হবে আস্তেধীরে, রসিয়ে রসিয়ে। বইয়ের নাম 'অর্ধেক জীবন' কারণ লেখক তাঁর জীবনের বাকি অংশ নিয়ে লিখে যেতে পারেননি।
সুনীলের লেখার ধরন আমার সবসময়ই ভালো লাগে, প্রাঞ্জল, পোলাওয়ের মতন ঝরঝরে। আর তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সব কাহিনি যেন মশলার রসদ। ব্রিটিশদের পতন, দেশভাগ, তাঁর ছাত্রজীবন, কর্মজীবন, বিদেশ ভ্রমণ, প্রেম, বিয়ে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- সবই আছে এই বইয়ে। লেখক এখানে তাঁর জীবনের অন্যতম কঠিন সময়গুলোর কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। শুধুমাত্র ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়তে হবে দেখে কলেজ বাদল, নিজ দেশ ফরিদপুরে ফেরত না যেতে পারার কষ্ট, বিদেশে জীবন গড়ার হাতছানি, অর্থাভাব সবই আছে এখানে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি চিনি না। না, ব্যক্তিগতভাবে তো অবশ্যই নয়। সত্যজিত রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' যখন দেখি, তখন কাহিনীকার হিসেবে তার নাম আসতেই কেমন বুড়ো একজনের কথা মনে হয়েছিলো। হতে পারে, আমরা কালার টেলিভিশনের জেনারেশান বলেই হয়তো। সাদাকালো কোনোকিছু মানে আভিজাত্য কিন্তু প্রাচীন। তবে সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি বা জানার ��ীমানা ছোট বলে হয়তো।
তিনি বুড়ো নন, কখনোই নন। লেখকের সার্থকতা কোথায় ? উত্তমপুরুষেই মনে হয়। উত্তমপুরুষের লেখা পড়ার একটা সুবিধা, যেনো একটা জেটপ্লেনে চড়ে বসা আর সাঁই সাঁই করে ঘোরাঘুরি করা। আমি টাইম যেনো মেশিনে করে দেশবিভাগ পূর্ববর্তী সময় থেকে আমার দেশের জন্মকথা পর্যন্ত পশ্চিমবাংলার এক বাউন্ডুলের জবানিতে ঘুরে আসলাম। দেশবিভাগের আগের দাঙ্গার বিবরণ এর আগে শেখ মুজিবর রহমানের জবানিতেও পড়েছি, তবে তা ছিলো নিতান্তই মুসলিম লীগের এক কর্মীর কথায়। সুনীলের জবানি দাঙায় হতবাক এক কিশোরের কথায়। দুজনই পশুত্বের কাছে অসহায় ছিলেন। তবে যেটা মনে হলো, 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে' সোহরাওয়ার্দীর সিদ্ধান্তটা কলকাতার মানুষদের কাছে ঠিক পরিস্ফুট ছিলোনা।
সে যাই হোক, সুনীল তার অর্ধেক জীবনে পাগলের মতো লিখে যাওয়ার অর্থ খুঁজেছেন, আমি আমার পড়ার নেশাকে সময় দেবার সময় খুঁজছি। মানবজীবন এত বিচিত্র বলেই কি সে এত সুন্দর ?
“আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা!”
আমেরিকার আইয়াও শহরের বিলাসবহুল আপার্টমেন্টে মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া ক্লান্তি আর বিষাদমাখা দীর্ঘকায় রাতগুলোতে একদিন কলমের ডগায় কবিতা হয়ে উঠে আসে উপরিউক্ত পঙক্তিগুলো। কবিতা ছিল তার নেশা, সে নেশা লেগে ছিল মনের প্রতিটি কোণায়। কবিতাকে অস্থিমজ্জায় ধারণ করা মহীরুহসদৃশ এই মানুষটি তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি নিয়ে রচনা করলেন 'অর্ধেক জীবন '।
জীবনের টুকরো ঘটনাই যদি বইটির প্রতিপাদ্য হবে তবে নামের ক্ষেত্রে কেন অর্ধেক জীবন? লেখক নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে, 'কেউ কি আজ পর্যন্ত তার পুরো জীবনের বর্ণনা দিতে পারসেন?' এর অবশ্য অন্য কারণও আছে। বন্ধু শব্দটি যেন আজীবন সুনীলকে ঘিরে রেখেছিল এক মায়াময় আবর্তে। লেখকের ভাষায় তাদের সম্পর্কগুলো অনেকটা 'সমকামীর মতো'। অর্থাৎ প্রেমিকার প্রতি যে অপ্রতিহত আকর্ষণ, তা কখনো কম পড়েনি বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে।তাঁর অজস্র গল্প, উপন্যাস ও কবিতায় তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আনন্দ বাগচি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনন্দ গুহঠাকুরতা (বুডঢা), শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় এর মতো কয়েকজন স্বাপ্নিক যুবকের দ্বারা মিলিত সৃষ্ট 'কৃত্তিবাস'। পরে এটার সাথে অনেকেই সম্পৃক্ত হয় আবার অনেকেই দূরে সরে পড়ে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপাদ রায়ের মতো আরও অনেক লেখক যেটার সাথে পরবর্তীকালে আজীবন সম্পৃক্ত থেকে যায়। বাংলা কবিতায় ভাষা প্রয়োগের ছুঁতমার্গকে সমূলে উৎপাটিত করতে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী সচেষ্ট, নবজাগরণ সেসময় যুগের দাবিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। আর এই নবজাগরণের পুরোধা ছিলেন সুনীল নামে এক সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যুবক। তারা শুধু কবিতার ছুঁতমার্গকেই উৎপাটন করতেই সচেষ্ট ছিলেন না, সমস্ত সংস্কার ভাঙ্গার দিকেও তাদের ঝোক। চিরাচরিত কোনকিছু মানতে তাঁরা নারাজ ছিলেন, উপভোগ করতেন ভেঙেচুরে নতুন কিছু শুরু করতে। সুনীলের জবানিতে__'কৃত্তিবাস পত্রিকার সুনামের চেয়ে দুর্নামই ছিল বেশি, আমরা সেটাই খুব উপভোগ করতাম। আমাদের ঝোঁক ছিল ভাঙচুর করার দিকে, প্রথা ভাঙা, ছন্দ ভাঙা, নৈতিকতা ভাঙা, মূল্যবোধ ভাঙা। শব্দ নির্বাচনে বেপরোয়া হওয়া….' গোটা অর্ধেক জীবন জুড়েই ইতিউতি ছড়িয়ে আছে তাঁর বন্ধুরা। এই বন্ধুদের পরপারে পাড়ি দেওয়ার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা না দিতেই বাকি অর্ধেকে কলমের আঁচড় বসায়নি সুনীল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তৃতীয় নয়ন মারফত দেখে নিতে চেয়েছেন নিজের বাল্য, কৈশোর ও যৌবনকে। এই রচনাটির সারা শরীরে আছে সমকালীন নানা ঘটনা। দেশভাগ, স্বদেশ হারানোর যাতনা। পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকে 'বাঙাল' তকমা পাওয়া, যেটা তখন ব্যবহৃত হত গালি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কলকাতার অবস্থা। বিভিন্ন রাজনৈতিক বলি হিসেবে সাধারণ মানুষের প্রাণনাশ, একজনের হিংসার প্রতাপে কিভাবে মারা পড়ে পুরো একটা জাতি। এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আখ্যান, সমসাময়িক রাজনীতি, নকশালবাড়ি আন্দোলন, ভারতীয় সমাজ কিছুই বাদ যায়নি। সবচেয়ে বেশি এসেছে কবিতার কথা, সাহিত্যের কথা, শিল্পের কথা, মানুষকে ভালোবাসার কথা আর বন্ধুদের কথা। আহা কি দুর্দান্ত যৌবন কাটিয়েছেন কবিতার সাথে তিনি। ভেবেছিলেন সারাজীবন কবিতা লিখেই কাটিয়ে দিবেন। গদ্য লিখতে চাইতেন না পারতপক্ষে। ভয় পেতেন, ভাবতেন- আমি কি পারব? অর্থের জন্য তবুও লিখেছেন দেশ পত্রিকায় নীললোহিত ছদ্মনামে। অর্থাভাব থাকলেও সুনীল কাটিয়েছেন এক বোহেমিয়ান জীবন। সময় পেলেই চলে যেতেন এখানে সেখানে। আমেরিকায় গিয়ে পুর্ণ সুযোগ সুবিধা পেয়েও থেকে গেলেন না, ফিরে আসেন অনিশ্চয়তা ভরা কলকাতায়, আবারও মেতে উঠেন কপি হাউসের আড্ডায়। বলতেন, 'মানুষ হয়ে জন্মেছি পৃথিবীতে, এখন পৃথিবীটা না দেখে যদি ঘরকুনো হয়ে বসে থাকি তাহলে কি করে হয়?' ছুটেছেন এদিক সেদিক। বইয়ের পাতার সাথে আমিও যেন ছুটেছি তাঁর সাথে। বইটা শেষ করেছি আস্তে আস্তে। তিনশোর অধিক পৃষ্ঠার সাথে সুনীল তার যে জীবনকে কালি দিয়ে লেপ্টে দিয়েছেন, একাত্ম হতে চেয়েছি তাঁর সাথে। এবং উপলব্ধি করেছি বাঙালদেশের ফরিদপুরের এক গ্রাম থেকে কলকাতায় উঠে আসা বালকটির জীবন বা তাঁর পরবর্তী জীবন কোন ফড়িং বা দোয়েলের মতো নয়। জীবনটা স্বদেশ হারানো এক কিশোরের, বোহেমিয়ান কবির, এক স্বাপ্নিক প্রেমিকের,জীবনানন্দের কবিতার বোধিপ্রাপ্ত লোকগুলোর মতোই বিপন্ন-বিস্ময়মাখা এক যুবকের। যে যুবক তার অর্ধেক জীবনের সমাপ্তি টানে__' এটা আমার দেশ নয়! এটা আমার দেশ নয়!' আস্ফালনে।
'অর্ধেক জীবন ' সুনীলের আত্মজীবনীমুলক বই। একদম শুরু থেকে, অর্থাৎ পূর্ব বাংলার ফরিদপুরে তাঁর আদি নিবাসস্থলের স্মৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকাল পর্যন্ত এর বিস্তার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর যেসব বন্ধুদের নিয়ে একসাথে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন, যাদের অনেকেই পরবর্তীকালে বাংলা ভষার উল্লেখযোগ্য কবি এবং লেখকের মর্যাদা পান, তাদের নিয়ে কাটানো বোহেমিয়ান জীবনের কথা লিখেছেন। অগ্রজ সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডার কথাও বিশদভাবে লিখেছেন। বেশ ভালো লেগেছে কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে গড়া ওঠা কবিগোষ্ঠী এবং তাদের কার্যক্রম। সুনীলের প্রথম প্রেমিকা যে অপর্ণা, তা এই বইয়ের মাধ্যমেই জানলাম। আর মার্গারিটার সাথে তার হৃদ্যতার কথা 'ছবির দেশে কবিতার দেশে ' বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন বিধায় এই বইয়ে খুব একটা পুনঃরুল্লেখ করেন নি। কেবল পরিচয়পর্ব এবং তারপরের কিছু স্মৃতিচারণা। তেমনিভাবেই এসেছে এলেন গিনেসবার্গ এবং অন্যান্য আমেরিকান, ফরাসী, জার্মান লেখকদের কথা। আরও যেটা জানলাম, তা হলো 'আত্মপ্রকাশ ' নয়, বরং 'যুবক যুবতীরা ' হলো সুনীলের লেখা প্রথম উপন্যাস। সাগরময় ঘোষ অনেকটা নতুন আঙ্গিকে লেখা 'যুবক যুবতীরা ' পড়ে মুগ্ধ হন এবং তারপরে এক আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আলাদা ডেকে নিয়ে দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লেখার জন্য বলেন। সেই উপন্যাসটি হলো 'আত্মপ্রকাশ '। সারাজীবন ধরে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সুনীল। সেই সব অভিজ্ঞতা নানাভাবে, নিজস্ব ভাষায় তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন সম্পাদকদের তাড়ায় হোক, জীবিকা নির্বাহের জন্যই হোক আর সাহিত্যকে পবিত্রতা থেকে নামানোর জন্যই হোক, সারাজীবন ধরে সুনীল লিখেছেন প্রচুর। হয়তো সেই কারণেই তাঁর গদ্যের ভাষা অনেকটাই সরল, তথ্যমূলক এবং অলংকারবর্জিত। একটানা পড়ে যেতে সমস্যা হয় না, আবার একঘেয়েও লাগে। এই আত্মজীবনীগ্রন্থেও ভাষার সেই ভঙ্গিমাই অনুসৃত হয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে সবসময়ই সময় দারুণ কাটে। অদ্ভুত বিচিত্র জীবন কাটিয়েছেন তিনি, সে জীবনের সব কাহিনী শুনতেও কখনোই বিরক্তির উদ্রেক হবে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইতিহাসকেও অন্যান্যদের থেকে আলাদা, সহজভাবে তুলে আনতে পারেন। এই বইয়েও করেছেন। আর মার্গারিট!! "ছবির দেশে কবিতার দেশে" পড়ার সময় যা মনে হয়েছিল তা আরেকবার মনে পড়ে গেল। কখনো আলাপের সুযোগ পাব না এরকম একজন নারীরা সাথে,মানতেও কষ্ট হয়।
মিষ্টিমামা মারা গেলেন দীর্ঘদিন রোগে ভুগে। চৌহাট্টার বাসায় তার প্রিয় সোফায় বসে আছি। সিলেটের বৃষ্টি, চলছেই, টিনের চালে মায়ার কার্নিভাল। শোকেসে কিছু বই, ঊর্মি ভাইর সম্ভবত, তার মাঝে এই বইটা তুলে নিলাম। সকালে ঢাকা ফিরবো, বইটা তো পুরোটা পড়া হবে না, তাই এমনিই খুলে বসলাম একটা পৃষ্ঠা, ২১৯, সেখান থেকেই শুরু করে দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে এগারোটা। তিনটার দিকে যখন উঠলাম, বইটার শেষ পাতা পড়া হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়লাম।
সাড়ে সাতটায় বাস। সাতটার কিছু আগেই ডেকে দেয়া হলো, টমেটো আলুর তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে ভাবছি বইটা কী করবো। মরাবাড়িতেও কি আর বইয়ের নেশা যাদের, তাদের ঠেকানো সম্ভব! কেউ তো পড়ার নাই, আমি তাই সংকোচ ছাড়াই ব্যাগে ঢুকিয়ে তাকে নিয়ে এলাম ঢাকা। গতকাল দুপুর থেকে শুরু, আজ দুপুরে শেষ, শুরু থেকে এক্কেবারে ২১৯ পৃষ্ঠার আগ পর্যন্ত।
স্মৃতিকথা? খুব বড় একটা উপন্যাস মনে হচ্ছে, ফার্স্ট পার্সন বয়ানভঙ্গীতে। সুনীলের মতন স্বাদু গদ্য আর কয়জন লেখার ক্ষমতা রাখে? কত বই পড়ার মাঝখানে উঠে যেয়ে বিড়ি টিড়ি খেয়ে আসি। পামুকের ব্ল্যাক বুক পড়ছি, তাতে দুই পাতা পরপর মনে হয় একটা বিড়ি টানা দরকার, কিন্তু অর্ধেক জীবন, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয় নাই। ধুম ধাম করে মগজের ভেতর কালাশনিকভ চালিয়ে ছুটে গেছেন প্রেমেন মিত্র, শক্তি, বুদ্ধদেব, অচিন্ত্য, তারাপদ, শরৎকুমার, কমলকুমার, বেলাল চৌধুরী, অ্যালেন গিন্সবার্গ আর কত কত মহারথীরা। ফরিদপুর থেকে কলকাতা, ফাঁকে আমেরিকাও, সবকিছুই কোন মনোটনি ছাড়া ধুমধাম, তবুও আবেগে ঘাটতি পড়ে নাই। এসে চলে গেছে রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃত্তিবাস, পাঁচ বা ছয়ের দশকের কোলকাতা। আর শেষমেশ ঘুরে ফিরে বাংলাদেশ। এইটা কি সুনীলের দেশ? লেখক নিজেও কতটুকু এর উত্তর জানেন তাও নির্ভরযোগ্য না।
পাঁচ তারকাও কম হয়, ৩২০ পাতার বই এমন মহানন্দে জীবনের চোদন উপেক্ষা করেও পড়ে ফেলা গেছে, বাইরে রোদ বৃষ্টি, সিলেটে বুঝি এখনো বৃষ্টি, আমার প্রিয় তিন শহরের দুইটা জুড়ে এই বই পঠিত হলো।
সুনীলের 'অর্ধেক জীবন' পড়ছিলাম অনেকদিন ধরে। মনে হচ্ছিলো একটি মানুষের জীবন এত অভিজ্ঞতাপূর্ণ হয় কীভাবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেন অকপটে সত্য কথা বলে চলেছেন। কোন ভনিতা নেই, কোন বাড়াবাড়ি নেই। বইয়ের একটা লাইন খুব মনে ধরেছে। কাউকে এভাবে কখনও বলতে শুনি নি।
"যৌনতা না জাগলে মানুষ যেমন অন্য কারও জন্য চুম্বকটান অনুভব করে না, তেমনই অন্য কারও জন্য চোখের জলও আসে না।"
এই নিয়ে তৃতীয়বার রিভিউটা লিখছি, কারণ গুডরিডস অ্যাপের ইন্টারফেস এত খারাপ! একটা মেসেজ আসলেও পুরো রিভিউ মুছে যায়। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে! কী অসাধারণ একটি বই পড়ে শেষ করলাম! দেবাশীষ যখন প্রথমবার বলেছিলো যে এই বইটি ওর অনেক প্রিয়, তখন থেকেই আমার খুব ইচ্ছে ছিলো বইটি পড়ার। এবারের জন্মদিনে ওর কাছ থেকে বইটি উপহার পেলাম, তাই সে ইচ্ছে আর অপূর্ণ রইলো না। কী বিচিত্র জীবনই না কাটিয়েছেন সুনীল! পুরোটা সময় জুড়ে আমার মনে হচ্ছিলো যে আমি সুনীলের চোখ দিয়ে তার জীবনটাকে উপভোগ করতে পারছি, তার অনুভূতির তীব্রতাগুলো অনুভব করতে পারছি। বইটি পড়ে কখনো খুব হেসেছি, আবার কখনো চোখের পানি সামলে রাখতে পারি নি। কী সুন্দর একটা সময় কাটিয়েছি পুরোটা সময়! সুনীলের জীবন আর আমার জীবন মিলে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। ওর চিঠি লেখার অভ্যাস, ওর বই পড়ার অভ্যাস, সবকিছু তীব্রভাবে অনুভব করার প্রবণতা, টিউশনি করানো–এমন অনেক কিছুই! প্রিয় লেখকের সাথে এমন মিল পেলে কার না ভালো লাগে! যে চ্যাপ্টারটাতে সুনীল তার আমেরিকা থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা লিখেছেন, সেটা পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। মনে হয়েছে, মানুষ কবিতাকে এতটাও ভালোবাসতে পারে? খুশিও হয়েছিলাম তিনি এমন সিদ্ধান্ত নেয়াতে। না হলে "সেই সময়"-এর মত অসাধারণ বই কীভাবে পেতাম? আবার সুনীলের "সিরাজউদ্দৌলা" নাটকে অংশগ্রহণের কথা পড়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে! এমন অবস্থা হয়েছিলো যে বই পড়া বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো হাসির দমক থামানোর জন্য! সুনীলের প্রথম হৃদয় ভাঙার কাহিনীটা পড়েও খুব মন খারাপ হয়েছে। ওর বাবার মৃত্যুর কথা পড়ার পরও তা-ই। কলকাতার সমসাময়িক সাহিত্যকেন্দ্রিক যে চর্চা, সেটাও উঠে এসেছে এই বইয়ে! কী অসাধারণ একটা সার্কেল! ভালো লেগেছে যে অমন মানুষদের সাথে মেলামেশার সুযোগ তার মেধাকে আরো বিকশিত করেছে। বইটা শেষ করতে একদমই ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু শেষ তো করতেই হবে! এবং বইয়ের শেষটুকু পড়ে বেশ মন খারাপই হয়েছে। সুনীল আমাদেরও হতে পারতো! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, না হয়েই ভালো হয়েছে। এখানকার মানুষেরা ওকে ডিজার্ভ করে না। উল্টো দেখা যেতো ওকে ব্যান করা হয়েছে, ওর ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, এবং অন্যান্য। তার চেয়ে তিনি নিরাপদে লেখালেখি করতে পেরেছেন, সাহিত্যচক্র গঠন করতে পেরেছেন, সে-ই ভালো। সুনীলের মত আমিও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি, "এটা তোমার দেশ নয়, সুনীল।" পুরো বইটা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, সুনীল সত্যিই বলতে চেয়েছেন, "আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!" ইশ, আমিও সুনীলের মত একজন চমৎকার লেখক হতে পারতাম!
খুব ভালো লেগেছে বইটি। ৫-এ ৫ না দিয়ে পারা যায় না!
This entire review has been hidden because of spoilers.
ভালো বই। "ছবির দেশে কবিতার দেশে" পড়েই মূলত লেখকের আত্মজীবনীর প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম। হতাশ হতে হয়নি। ব্যক্তি সুনীলকে আরও বেশি করে আবিষ্কার করার সুযোগ আছে এই বইয়ে। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক জায়গাটুকু একটু বিরক্ত লেগেছে। এছাড়া বেশ লেগেছে।
This is really a good book, full of important lessons from life. নিজের কথা যদি বলি, আমার লাইফ ফিলোসফির সাথে সুনীলের চিন্তাধারার অনেক মিল আছে। তাই বইটা আরো বেশী ভাল লেগেছে। Recommended!
এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো পড়া বইটা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের প্রতিটি পরত যেন ছবির মতো করে সাজানো, শৈশব, দেশভাগ, সংসারের নিত্য সুখ দুঃখ, শিক্ষা জীবন,স্বরস্বতী পূজায় দেবীকে দেখে অনুভব করা অকপট স্বীকারোক্তি, বিদেশযাএা, মার্গারেটের স���থে পরিচয়, অসমাপ্ত প্রনয়, অবশেষে স্বাত্বী দেবী সাথে পরিচয় ও পরিণয়, একটা পাতা পড়েও খারাপ লাগেনি,সবাই এখানে মোটামুটি spoiler দিয়েছে কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে পুরো বিষয়টি পড়ে অনুভব করে visualization এর ব্যাপারটা অনেক আনন্দের রিভিউ পড়ার থেকে.(সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত)
আমার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলো এত ভাল লাগে কেন বুঝি না! প্রতিটি লেখাই আমার ভীষণ প্রিয়। এটাই বোধহয় না পড়ার ছিল শুধু, সেটাও পরে ফেললাম। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সময়টায় শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি ভালভাবেই এসেছে। তবুও মনে হল লেখক আরো কিছু ডিটেইল যোগ করতে পারতেন :(
মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা, দারিদ্র্য, বন্ধুত্ব, সংগ্রাম বিপ্লব আর কবিতায় তিলে তিলে সাধারণ এক শিশুর কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার এক অনবদ্য দলিল।
সুনীলের অর্ধেক জীবন । ফরিদপুরের পিতৃপুরুষের ভিটা থেকে উত্তর-দক্ষিণ কোলকাতা আঁতিপাঁতি করে কবি হয়ে ওঠা সুনীলের অর্ধেক জীবন । কবিতার অপূর্ব ঘোরে আক্তান্ত এক বাঙাল ছেলের বেড়ে ওঠার উছিলায় ঘুরে ফিরে এসেছে সমকালের কত শত ঘটনা প্রবাহ । সবটাই সুনীলের স্বভাব সুলভ অকপটতায় । বালক বেলায় ফরিদপুরের বাংলার প্রকৃতি-জনমানুষ-সামাজিক আচার আচরণের ছবির পর ছবি । তারপরে আবার নাড়ী-শেকড় ছেঁড়া দেশ ভাগ । উপনিবেশিক বিষ বাষ্প থেকে মুক্ত হয়ে পাওয়া গেলো এমনি এক দেশ যে মানুষকে নিজের 'দেশ'কেই ছেড়ে-ছুড়ে পাওয়া নতুন এক দেশ । কী এক নির্মম মশকরা । তবে সময় অনেকে বয়ে গেছে, বলা যায় নিষ্পেষিত পূর্ব বঙ্গের মুসলমান শেষ মেশ পাকিস্তানের মতো উদ্ভট রাষ্ট্রে গ্রেফতার হবার পরো জনযুদ্ধের পর পেল নিজের দেশ । গড়ে উঠলো এক মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী । তারপর এখন আবার সে পেল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র । সে আরেক আলাপ । মজার বিষয় হলো ফরিদপুর দিয়ে শুরু করে অর্ধকে জীবনের সমাপ্তি ঘটলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েই । ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয় ।
দেশ ভাগের পরে আঁশে আঁশে দারিদ্র্যের যন্ত্রণা । তাতে কী! কখনো ব্যান্ড বাদক, আবার বয় স্কাউট বা থিয়েটারের অভিনেতা! তারপর কী যে এক অমোঘ শক্তি টেনে নিয়ে গেলো সুনীলকে । জীবন যুদ্ধের সাথে সাথে এমন জীবনের উদযাপন, কবিতা নামের এক রহস্যময় সৃষ্টিশীলতাকে ধেয়ে চলা! বইয়ের প্রতি অপ্রতিরোধ্য টান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা আর বীভৎস রকম উদযাপনের আড্ডা । ঘটনা প্রবাহে জড়িয়ে থাকা কত চেনা সাহিত্য ব্যক্তিত্ব-কিংবদন্তি । কবি! কবি! কবি! কবি-ই হতে চেয়েছিলেন সুনীল । হয়েওছেন । জন্ম দিয়েছেন, গড়েছেন "কৃত্তিবাস"র মতন এক দীর্ঘজীবী কবিতা পত্রিকার । খেয়াল করবার মতো ব্যাপার হলো, এমন হুলুস্থুল চরিত্রের সুনীল সদা সজাগ আন্তর্জাতিক-স্থানিক রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি নিয়ে । বার বার তার লেখায় তার পরিচয় মেলে । আর ষাটের দশকে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পেয়েও শুধুমাত্র বাংলা কবিতার টানে, বাংলাভাষীদের মধ্যে থাকবার ইচ্ছা বুকে নিয়ে কেউ আবার কোলকাতায় ফিরে আসে! সে কোন গবেট? সুনীল সেই বিচিত্র প্রকৃতির ছেলে । তবে কার জীবনের মোড় যে কোথায় ঘুরে যায় । সময়ের ঘোর প্যাঁচে সেই কবিতায় পাওয়া সুনীলের হাত থেকে ছুটে বেড়িয়ে চলল হাজার হাজার পৃষ্ঠা গদ্য । ভাবা যায়! সুনীলের উপন্যাসিক জীবনের শুরুর দিকের সৃষ্টি "অরণ্যের দিন রাত্রি" । সত্যজিৎ এর হাতে পরে মূল কাহিনীর খোলনলচে সিনেমাটিক কারণেই কিছুটা বদলে এক অনবদ্য আধুনিক সিনেমা পাওয়া গেলো । ভাবতেও অবাক লাগে, এই সিনেমা যদি না হতো আমরা কি এত সব অসাধারণ গদ্য পেতাম? পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময়, প্রথম আলো?
কতো কষ্ট সহ্য করলে তবে সুনীল হওয়া যায় এটা তার একটা দলিল। আবার জীবনকে কতটা চেটেপুটে উপভোগ করলে তবে নীললোহিত হয়ে ওঠা যেতে পারে এ যেন তার জ্বলন্ত বিবরণ। এই বইটি অবশ্যই পড়বেন এবং অন্যকে পড়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করবেন।
‘অর্ধেক জীবন’ সুনীলের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।উপন্যাসের ব্যাপ্তিকাল সুনীলের জন্ম থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কিছু সময়।উপন্যাসে সুনীলের শৈশবজীবন,দেশ ভাগজনিত সমস্যার ফলে আর্থিক টানাপোড়ন,সাহিত্যজীবন ও প্রবাসজীবন সহ অনেক কিছুই উঠে এসেছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লেখক তাঁর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন।কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখক তাঁর নিজস্ব মতবাদও ব্যক্ত করেছেন। সুনীলের আত্মজীবনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ পড়ে খুব ভাল লেগেছিল,এটাও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।উপন্যাসের নাম নিয়ে খানিকটা কৌতূহল ছিল লেখক সেটা শুরুতেই মিটিয়ে দিয়েছেন।সুনীলের ট্রিলজি যারা পড়েছেন তারা এই উপন্যাস পড়লে খানিকটা অবাক হবেন কারন সুনীলের ট্রিলজির অনেক চরিত্রই তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।সেই সময়ের বিধুশেখর কিংবা পূর্ব-পশ্চিমের অতিন,প্রতাপের অনেক ঘটনার সাথে সুনীল অথবা সুনীলের পরিচিতদের মিল আছে। সুনীল,হুমায়ূন কিংবা জাফর ইকবালের জীবনী পরে একটা ব্যাপারে মিল দেখলাম,এরা কেউ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় নি,অনেক কষ্ট,ত্যাগ-তিতিক্ষার পর তারা আজকের এই উচ্চতায় এসেছে।আমরা না চাইতেই সব পেয়ে যায়,কষ্টের সংজ্ঞা কি কখনও ভাবতে হয় না,তাই গরু রচনাও মুখস্ত করতে হয়।নিজের মাথা থেকে কিছু বের হবার সুযোগ পায় না,আত্মজীবনী লেখার মত কোন কাজ ও করা হয়ে উঠে না।
ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া এক বালক থেকে সুনীলের কবি হয়ে ওঠার গল্প শোনায় এই 'অর্ধেক জীবন'। দেশ ভাগ হবার পরে বাস্তুভিটা ছাড়তে হয়েছিলো তাঁর পরিবারকে। অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই হয়তো লিখেছিলেন "মানুষের জন্মভূমি আর স্বদেশ সব সময় এক থাকে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার জন্মভূমি বিদেশ হয়ে গেছে।" কোলকাতায় ছোট থেকে স্কুল জীবন। স্কুল জীবনের সব গল্পগুলো, রোমাঞ্চকর সব ভ্রমণের কথা একে একে সব আসতে থাকে যতোই পাতা বদল হয়। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইচ্��াকৃত ভাবে দূর্ভিক্ষের বিভৎসতা। এরপর সুনীলের স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখার কথা। কলেজ জীবনের প্রেম৷ টিউশনি করিয়ে প্রথম দিকে চালানো জীবন সংগ্রাম। তারমধ্যেও থেমে থাকেনি বাউণ্ডুলেপনা, রাত বিরেতের আড্ডা কিংবা মদের ঠেকে আসর জমানো। সেই প্রথম বয়স থেকেই কবিতার প্রতি দারুণ ঝোঁক। কোন কোন মানুষের যে কবিতার প্রতি প্রচন্ড টান যার কারণে সব মোহ মায়া কিংবা বিলাসিতাও ত্যাগ করতে পারে তা জানা যায় পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে। 'হরবোলা' কিংবা 'কৃত্তিবাস' কবিতা কখনো থেমে থাকেনি। জীবনানন্দ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ; বুদ্ধদেব বসু কিংবা কমলকুমার এমনকি সত্যজিৎ রায়ের মতোন বিখ্যাতরা তাঁর বন্ধু। কফি হাউসের আড্ডা কিংবা কোন বন্ধুর বাড়িতে বসে চুটিয়ে তাস খেলা। কবিতা কিন্তু থেমে থাকেনি। অনেক সময় পকেটে টাকা নেই, ভাত জুটবে কি না তার অনিশ্চিতয়তা তার পরও থেমে থাকেনি কবিতারা। কিছু কিছু বই পড়া শুরু করার পর নিজেকেও বইয়ের অংশ মনে হতে থাকে এটিও তেমন। এরপর সেই জীবনে (অপর্ণা) প্রথম প্রেম, দীর্ঘ চিঠি এবং প্রেম পরবর্তী পাড়ার দাদাদের হাতে ধরা পরে যাওয়া।কেরানীর চাকুরি, সেখানেও সেই বাউণ্ডুলেপনার জন্য থাকা হয়নি বেশিদিন। এরমধ্যে বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ের ঘাড়ে আসা সেই সাথে 'কৃত্তিবাস' পত্রিকারও দায়িত্ব নিজের হাতে সামলানো। জীবন নিয়ে বাজি খেলাও কিন্তু একবারও থেমে থাকেনি। হুটহাট দিকবিদিক ঘুরে বেড়ানো কিংবা বন্ধুদের সাথে সেই সব ছন্নছাড়াময় কাজগুলো চলছেই। কৃত্তিবাস সম্পাদনা কালে গড়ে ওঠা কবি গোষ্ঠী আর তাদের চমৎকার সব আড্ডার গল্প। কোলকাতায় আমেরিকান কবি এলেন গিনেসবার্গের সাথে পরিচয় এবং পরবর্তীতে তার সাথে কাটানো বোহেমিয়ান জীবন। এরপর আমেরিকা যাত্রা এবং বান্ধবী মার্গারিটার সাথে পরিচয়। সেই বাংলার মায়া কাটাতে না পেরে আবার সেই বাঙলাতেই ফিরে আসা। এরমাঝে অনেক দেশের কবি সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয়। দেশে আসার পর স্বাতী নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয় এরপর সেই পরিচয় গড়ায় প্রণয়ে। বিপ্লব কোলকাতার বুকে আসে অনেকবার, নকশালবাড়ী আন্দোলনের সময়কার কথাও জানা যায় তাঁর লেখায়। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস (যুবক-যুবতীরা) পড়ে সাগরময় ঘোর দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় একটি উপন্যাস জমা দিতে বলেন। তারপর তিনি লেখেন 'আত্মপ্রকাশ' নামের উপন্যাসটি। অথচ এতোদিন ধরে জানতাম 'আত্মপ্রকাশ'ই তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস। কিছু লেখক এবং কিছু বিপ্লবীর তাঁর উপর বিরূপের কথাও তিনি নিজেই বলেন। কারণটা তিনি এক পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন বলে অথচ তিনি সেই বিপ্লবকে অসমর্থন করেননি কখনো। এরপর আসে মুক্তিযুদ্ধের কথা। উদ্বাস্তুদের বিষম দুঃখের দিনগুলোর কথা। দেশ স্বাধীন হবার পরে বাংলাদেশে আসার পর তিনি নিজের ভিটেমাটির কথা ভেবে অনেকটা স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন। সুনীল তাঁর 'অর্ধেক জীবন'কে আত্মজীবনী বলেননি বলেছেন জীবন-ঘেষা উপন্যাস। বইটিতে বারংবার উঠে এসেছে কবিতার কথা। সুনীল আর কবিতা যেনো একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িতো। নীরার প্রেমে মশগুল সুনীল আর এই অর্ধেক জীবনের সুনীল মোটেও এক নয়। বইটিতে বার বার এসেছে কৃত্তিবাস পত্রিকার কথা। জীবনের নানান উত্থান-পতনের কথা। কবিতার কথা, তৎকালীন সমাজপতিদের আগ্রাসনের কথা, উদ্বাস্তুদের নরকতুল্য জীবনের কথা। জীবনানন্দের প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা। কোলকাতার প্রতি মোহ। বাংলার ভাষা ও মানুষদের প্রতি দরদ। বাউণ্ডুলে জীবনের কথা। আছে বিপ্লব আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। সমসাময়িক অনেক কবি-সাহিত্যিকদের কথা। কী নেই বইটিতে? নিজের সাথে সঙ্গ দিতে চাইলে বইটি হতে পারে ভালো একজন সঙ্গী। বই পড়া চলতে থাক। লেখকেরা দীর্ঘজীবী হোক।
This entire review has been hidden because of spoilers.
অনেকদিন পর কোনো বই নিয়ে বসেছিলাম। পড়ার অভ্যেসটা বেশ কিছুদিন ধরে হারিয়ে ফেলেছিলাম, হয়তো পড়াশোনার চাপ, নতুন শহর, নতুন জীবন, কিংবা মনোযোগের অভাবের জন্য। অন্য দেশে চলে আসার পর জীবনটা অনেকটাই বদলে গেছে। সবকিছু যেন practical আর time-bound হয়ে গেছে। বই পড়া বা রিভিউ লেখা যেন আর কোনো প্রয়োজনীয় কাজ নয়, বরং একসময়ের বিলাসিতা। তবুও একদিন হঠাৎই অর্ধেক জীবন খুলে বসেছিলাম। মনে হয়েছিল, সুনীলের নিজের জীবনের গল্প পড়ে যদি একটু নিজের জীবনটাকেও নতুনভাবে দেখা যায়।
এই বইটাকে আত্মজীবনী বলা ঠিক হবে না। বরং এটা জীবনের টুকরো টুকরো উপলব্ধির গল্প, যেখানে স্মৃতি, অভিমান, বন্ধুত্ব, প্রেম, রাজনীতি, দেশভাগ, সব কিছু মিশে আছে এক ব্যক্তির চোখে দেখা জগতে। সুনীল নিজের জীবনের নানা মুহূর্তকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, পাঠকের মনে হয়, এ যেন তার নিজেরই কোনো অতীত। তাঁর শৈশবের বর্ণনাগুলো এত সুন্দর, এত সহজ, এত জীবন্ত যে মনে হয় চোখের সামনে সেই কুমোর জলধর প্রতিমা গড়ছে, বাতাসে ধূপের গন্ধ, দূরে শিউলি ফুলের গাছ দুলছে।
যেটা সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গেছে, সেটা হলো লেখকের ভেতরের মানুষটার সততা। তিনি নিজের ভুল, নিজের দুর্বলতা, নিজের কৌতূহল সবই অকপটে লিখেছেন। কৈশোরের সেই সরল, অপ্রস্তুত মুহূর্তগুলো যখন তিনি প্রথম নারীশরীর, ধর্ম বা প্রেম নিয়ে ভাবতে শিখছেন, সেগুলো তিনি এমন এক খোলামেলা ভঙ্গিতে বলেছেন যে, সেটা কোনো অশালীনতা নয়, বরং এক মানবিক সত্যের প্রকাশ। মনে হয়, সাহিত্যে সত্যিকারের সততা এটাই।
বইয়ের মাঝেমাঝে যখন তিনি নিজের দেশ নিয়ে কথা বলেন, তখন বুকের ভেতরটা হালকা টনটন করে ওঠে। “আমার জন্মভূমি বিদেশ হয়ে গেছে” – এই লাইনটা যেন আমার জন্যই লেখা। অন্য দেশের আকাশের নিচে বসে নিজের দেশের মাটির গন্ধ মনে পড়লে, বুঝতে পারি তাঁর কথার গভীরতা। আমি এখন বুঝি, দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, মানসিকও। এই বিদেশে, নিজের ভাষা, নিজের বই, নিজের মানুষের থেকে দূরে থাকা অবস্থায় সুনীলের লেখা যেন এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করে দিল, যা আমাকে আবার ফিরিয়ে নিল আমার ভাষার কাছে, আমার শিকড়ের কাছে।
বন্ধুত্বের অধ্যায়গুলোতেও এক অদ্ভুত মায়া আছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা পড়তে গিয়ে মনে হয়, আমাদের এই প্রজন্ম সেইরকম গভীর বন্ধুত্ব আর তৈরি করতে পারছে না। আমরা সবাই খুব ব্যস্ত, খুব বিচ্ছিন্ন, খুব নিজের মধ্যে। কিন্তু সুনীলদের বন্ধুত্ব ছিল এক ধরনের প্রতিশ্রুতি, যেটা এখনকার জীবনে প্রায় বিলুপ্ত।
রাজনীতি নিয়ে তাঁর চিন্তাগুলোও অসাধারণ। বিশেষ করে নকশাল আন্দোলন বা তৎকালীন কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসঙ্গে তিনি যে আত্মবিশ্লেষণ করেছেন, তাতে মনে হয়েছে, তিনি কখনোই কোনো মতের দাস ছিলেন না। তিনি স্বাধীন চিন্তার মানুষ ছিলেন, আর সেই স্বাধীনতাই তাঁর লেখার প্রাণ।
সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে, তাঁর ভাষার সরলতা। কোথাও বাড়তি অলংকার নেই, তবু প্রতিটি বাক্যের মধ্যে একটা গভীর ভাব আছে। পাঠক হিসেবে কখনো মনে হয়েছে, তিনি নিজের জীবন নিয়ে কথা বলছেন, আবার কখনো মনে হয়েছে, তিনি আমার জীবনের কথাই লিখেছেন। তাঁর এই লেখাগুলোর মধ্যে যে জীবনবোধ, তা এক ধর��ের প্রশান্তি দেয়।
বইটার শেষ অংশটা পড়ে একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করেছিল। যেন কথা শেষ হলেও গল্পটা শেষ হয়নি। হয়তো তাই বইটার নাম অর্ধেক জীবন। আসলে কারও জীবনই তো পুরোটা লেখা যায় না। আমরা সবাই অর্ধেক থেকে যাই, কোনো না কোনোভাবে।
বিদেশে এই একলা জীবনে, যখন নিজের ভাষায় কথা বলার মানুষ কম, তখন এমন একটি বই যেন নিঃশব্দে পাশে এসে বসে। অনেক বছর পর এমন একটা বই পড়ে মনে হল, শব্দের ভেতরেও আশ্রয় পাওয়া যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা আমার কাছে শুধু সাহিত্য নয়, একপ্রকার আত্মশুদ্ধি।
এই বইটা পড়ে মনে হয়েছে, জীবন যত জটিলই হোক, তাকে দেখে, বুঝে, লিখে রাখা যায়। হয়তো সেটাই শিল্পীর আসল কাজ।
সা রে গা মা পা ধা নি, বোম ফেলেছে জাপানি। বোমের ভিতর কেউটে সাপ, ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ।
-আজ সভ্য দেশের সভ্য জাতী হিসেবে মাথা উঁচিয়ে থাকা জাপানি রা ঠিক কতটা সভ্য! কতটা সভ্য তাদের ইতিহাস ও অতীত! ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পটে আঁকা জয়নুল আবেদিনের তুলির ছোয়া প্রায় সকলেই দেখেছে কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষের ঠিক কতটা ছিলো প্রাকৃতিক আর কতটা মানবসৃষ্ট তা ঘেটে দেখা হয়নি। কিছুটা খেলার ছলে জাপানি দের ফেলে যাওয়া বোমা দুর্ভিক্ষ রুপে আঘাত হানে তৎকালীন ভারতবর্ষে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবের কোনো আঁচ না পাওয়া নিরীহ ফরিদপুরের আমগাঁ ও তখন কৃত্রিম মহামারী তে আক্রান্ত৷ জাপানের করে যাওয়া খুনসুটির মাশুল দিতে প্রাণ গিয়েছিলো ত্রিশ লক্ষ মানুষের। খুনসুটির সেই বোমা যুদ্ধভীতি সৃষ্টি করেছিলো রাজনীতির মারপ্যাঁচে না থাকা ভারতবর্ষের নিরীহ বাঙালি মানুষের মধ্যে। সেই ভীতির ফলে বেআইনি ভাবে কুক্ষিগত হয়েছিলো খাদ্যশস্য, শুরু হয়েছিলো কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। পাছে জাপান ভারতবর্ষ দখল করে নেয় তাই মাননীয় ব্রিটিশ সরকার চার্চিল নিলেন কার্যকরী পদক্ষেপ। তারই কল্যানে অবৈধভাবে মজুদ করে রাখা হয় খাদ্য। নৌকা এবং গরুর গাড়ি হয় বাজেয়াপ্ত। এতে চাল বা খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা ও ভেঙ্গে পড়ে। মৃত্যুর ঢল নেমে আসে রাস্তায়। বুভুক্ষু হাজার হাজার মানুষ একমুঠো অন্নের আশায় স্রোতের মত বইতে থাকে কলকাতার দিকে। সেই সময় ভুরিভোজ চলছে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও তাদের তোষামুদে অবস্থাপন্ন ভারতীয় লোকজনদের বাড়িতে। তারা ফিরেও চায়নি সেই বুভুক্ষু দলের দিকে। ঠিক যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় - " অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে, আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি"।
বলছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা - অর্ধেক জীবনের কথা। ঠিক যেন আত্মজীবনী নয়, তার লেখা স্বীকারোক্তি। ফরিদপুরের আমগাঁ তে জন্ম নেয়া দরিদ্র পরিবারের বড় সন্তান সুনীল। বাড়ির প্রধানকর্তার পেশা হলো শিক্ষাকতা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ঝঞ্জ্ঝা বিভ্রাটের মধ্যে বেচে থাকতে চাইছে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলের বিচিত্র সব আত্মকথনের সমন্বয় এই " অর্ধেক জীবন"। বিশ্বযুদ্ধের রোষানল বা স্বদেশী আন্দোলনের কিছুই যেন বোঝেনা কিশোর সুনীল। তবুও গায়ে মাখতে চাই বিপ্লবের স্বাদ। স্বদেশী আন্দোলনের কোনো এক বিপ্লবের মিছিলে ধাক্কা খেয়ে সেই বিপ্লবের স্বাদ গায়ে মেখেছিলো কিশোর সুনীল। সুনীল লাভ করে গেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল থেকে শুরু করে আধুনিক তরুণ কবি ও কবিতার উত্থান। তিনি দেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথের শবযাত্রা। দেখে গেছেন মহাত্মা গান্ধী কে। শুনে গেছেন সুভাষ বোসের ভাষণ। দেখে গেছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কে। শুনে গেছেন তার নির্ভুল বাংলা ভাষণ। সংস্পর্শে থেকেছেন সাধারণ একজন মলাট শিল্পী "সত্যজিৎ রায়" এর। কলকাতার মেসের শক্ত বিছানায় বিভোর হয়ে ঘুমানো সুনীল বিলেত পারি দিয়ে নিউইয়র্কের আয়ওয়া শহরের নরম তুলার বিছানায় নির্ঘুম রাত পার করেছেন। নিউইয়র্কে কাটাচামচ দিয়ে অভিনব খাবার খাওয়া ব্যক্তি টি দুর্ভিক্ষে সেদ্ধ আলু খেয়ে ও গরম ধোয়া উঠা ভাতের স্বপ্ন দেখে পার করেছেন শৈশব। কবিতা প্রেমি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জীবনের বাঁকে এসে কখন ঔপন্যাসিক হয়ে উঠেছেন সেটা টের পাওয়ার আগেই খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা সত্যজিৎ রায় এর অনুরোধ সুনীলের উপন্যাস থেকে নিজের সিনেমা বানানোর ঘটনায় আরো একবার নির্ঘুম রাত কাটানো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই চিত্র যে কাউকে আলোড়িত করবে।
ভাবতে অবাক লাগে- পাঁড়াগায়ের এক অখ্যাত শিশু, পরবর্তীতে টেনে-টুনে এম.এ. পাশ করা কলকাতা শহরের এক অতি সাধারণ যুবক কী করে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের এক প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক!
শুরুতেই লেখক শৈশবে পিতৃভূমি ফরিদপুরের স্মৃতি বর্ণনা করেন। ক্রমান্বয়ে চলে আসেন তার কৈশোর ও যৌবনের সময়গুলোতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অক্ষশক্তি-মিত্রশক্তি, হিটলার-মুসোলিনি, হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনাগাঁথা বইটিকে করেছে ইতিহাস-আশ্রিত। বহু ঐতিহাসিক চরিত্র সুনীলের সম্মোহনী ভাষাপ্রয়োগে যেন হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। দেশবিভাগের কালো থাবা কী করে এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নকে করেছিল ক্ষতবিক্ষত, লেখক তা বর্ণনা করেছেন নিজ-অভিজ্ঞতার আলোকে। নিজের জন্মভূমিতে স্থায়ীভাবে ফিরে যেতে না পারার বাসনা তাঁকে আমৃত্যু দগ্ধ করেছে।
ক্রমে বইটিতে চলে আসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানের সামরিক উত্থান, বাষট্টির চীন-ভারত যুদ্ধ, পয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনীল তার প্রিয় বন্ধু অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে ভ্রমণ করেন ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে। শরণার্থী শিবিরের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের নিমিত্তে তিনি ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাতের পর রাত গল্প করেছেন নিছক বন্ধুর মত করে। পত্রিকার সম্পাদক হবার সুবাদে ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে লেখাপড়া করতেন প্রচুর। তার সাথে এই জীবন-ঘেঁষা অভিজ্ঞতাগুলো যুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে তাকে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হয়ে উঠতে ভীষণভাবে সাহায্য করে।
এই তো গেল সময়ের গল্প। এর বাইরে সুনীলের সাহিত্য জীবনেও যেন অভিজ্ঞতার শেষ নেই। কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু-সহ প্রখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিকের সাহচর্যে থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনকে বৈচিত্রের স্বাদ উপহার দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশীয় লেখকদের সাথেও গড়েছেন সখ্যতা। দেশ থেকে বিদেশে, শহর থেকে গ্রামে ভ্রমণ করে জীবনের নানারূপ দর্শন করেছেন। লাইব্রেরীতে যেমন মুখ গুঁজে থেকেছেন, তেমনি গিয়েছেন পতিতালয়েও। তিনি হতে চেয়েছিলেন কবি, গদ্য লিখতেন নিছক অনাগ্রভরে কিংবা পেটের দায়ে। অথচ সময়ের স্রোতে একসময় তিনিই পেয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকের তকমা। তার রচিত "অরণ্যের দিনরাত্রি" এবং "প্রতিদ্বন্দ্বী" উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। সবমিলিয়ে জীবদ্দশাতেই সুনীল বাংলা সাহিত্যের একজন লিভিং-লেজেন্ডে পরিণত হন।
"অর্ধেক জীবন" মূলত আত্মজীবনীর মোড়কে ঢাকা সময়ের উপাখ্যান। দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার চিরাচরিত সম্মোহনী ভাষা ও শব্দচয়নে লিপিবদ্ধ করেছেন শৈশব থেকে শুরু করে পড়ন্ত যৌবন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি। উপমহাদেশের খুব কম সাহিত্যিকই বেঁচে থাকতে যশপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুনীল নিঃসন্দেহে তাদের মাঝে অন্যতম। সুনীলের জীবদ্দশায় একজন পাঠক হিসেবে আমি তার গুণগ্রাহী হয়ে উঠতে পারিনি বলে মাঝে মাঝে নিজেকে হতভাগ্য মনে হয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় খুব বেশি দিনের না। এর মধ্যেই তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই 'অর্ধেক জীবন' পড়ে ফেললাম। পড়ার আগে ভাবছিলাম যে বইয়ের নাম কেন অর্ধেক জীবন? তিনি কি তাঁঁর অর্ধেক জীবন কাহিনি এই বইতে লিখেছেন? নাকি অন্য কিছু? অবশ্য লেখক বইয়ের শুরুতেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
লেখকদের ব্যপারে আমার কৌতুহলের সীমা নেই। তারা কিভাবে বড় হয়েছেন, কোন পরিবেশে থেকেছেন, কীভাবে লেখালেখির জগতে আসলেন- এসব ব্যপারে জানতে বেশ আগ্রহী। তাছাড়া কিভাবে একজন মানুষ শূন্য থেকে শিখড়ে পৌঁছে যায়, কিভাবে এক অখ্যাত অঞ্চলের কোনো ব্যাক্তির নাম একটা সময় এসে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে - তা জানতেও কৌতুহলবোধ করতাম।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পিতা ছিলেন শিক্ষক, পরবর্তীতে তারা কলকাতায় এসে থিতু হন। এখানেই তাঁর পড়াশোনা, সাহিত্য জীবনের সূচনা, প্রেম বিয়ে ভালোবাসা। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি আমেরিকাতেও থেকেছেন বেশ কিছু দিনের জন্য। সেখানে মার্গারিট নামক এক তরুণীর সাথে বেশ সখ্যতাও গড়ে উঠে। এছাড়া এলেন গিনেসবার্গসহ আরও অনেক বিদেশি সাহিত্যিকদের সাথে লেখকের পরিচয় হয়।
কলকাতায় লেখক ও তাঁর বন্ধুবান্ধবরা মিলে সাহিত্যচর্চা শুরু করে। নতুন লেখক কবিদের কম সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রথমদিকে কবিতাই লিখতেন। একটা কবিতা পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন 'কৃত্তিবাস' নামে। এটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বিচিত্রসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি, শিখেছেন নতুন নতুন সব বিষয়- যা ফুটিয়ে তুলেছেন এই বইটার মধ্যে। অগ্রজ সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল সেটার বর্ণনাও রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সাহিত্য-সমাজ কেমন ছিল তার বেশ চমৎকার ধারণা দিয়েছেন। লেখকরা মিলে একটা নাট্যদলও করেছিলেন ও নাটক মঞ্চায়িতও হয়েছিল।
লেখকের লেখার ভাষা খুবই চমৎকার, যেভাবেই হোক লেখক সারাজীবনে প্রচুর লেখালেখি করেছেন, কখনো হয়তো অর্থের জন্য, কখনো বা নিজ তাগিদে। এত পরিশ্রমেই তাঁর লেখার হাত এতটা দারুণ হয়ে উঠেছে। লেখক যে শুধু নিজের সাহিত্য জীবন সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন এমন না, তৎকালীন ইতিহাস, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক বিষয়গুলোও দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া উনার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল সেটাও লিখেছেন অবলীলায়।
বইটা পড়তে সাজেশন দেয় বড় আপু। তিনি বলেছিলেন যে সার্থক আত্মজীবনী বই সেটাই যেটা একজনের জীবনীর সাথে সাথে প্রকাশ করে তাঁর দর্শন, সেই সময়ের ইতিহাস আর আশেপাশের যাপিত জীবন। সে দিক দিয়ে এটা একটা সার্থক বই। বইটা পড়ে অনেক ভালো লেগেছে। একজন অসাধারণ মানুষ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারলাম, সেই সাথে প্রিয় লেখকের তালিকায় আরও একটা নাম যুক্ত হলো।
লেখক সুনীল-কে টাইম-ট্রাভেলার বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না।
বৃটিশ-শাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৬০'র দশকের উত্তাল নক্সাল আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ... সব মিলিয়ে তাঁর একজীবনে একইসাথে তিনি অনেক সময়কালের স্বাক্ষী।
ভালো লেগেছে তাঁর মার্কিন-মুল্লুকে যাওয়ার গল্প নিয়ে। জীবনে প্রথম "আইওয়া" প্রদেশের প্রেমে পড়ি What's Eating Gilbert Grape সিনেমাটা দেখতে গিয়ে। দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ি অর্ধেক জীবন-এ লেখকের বর্ণনা পড়ে।
অর্ধেক জীবন, যেমন উপন্যাসের নাম, তেমনি লেখকের ছোটবেলার সময় থেকে বিবাহ পরবর্তী কয়েক বছরের কথা আমরা এই বইটিতে পাই। ফরিদপুরে বসবাসকারী এই পরিবারটি একদা বাড়ি পাল্টে চলে আসে কলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে প্রবল খাদ্যসংকট ও মৃত্যুমিছিল তিনি দেখেছেন চোখের সামনে, খুব আবছা স্মৃতি হলেও গান্ধীজিকে দর্শনের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তবে তাঁর ছোটবেলার সময়টির গল্প বলার সময় তিনি তাঁর নিজের কথা বলার চেয়ে সেই সময়কালটি তুলে ধরায় মনোনিবেশ করেছেন বেশি। এবং সেটাই আমাকে এই উপন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এই উপন্যাসটি নিয়ে অনেক মিশ্র পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়েছি। অনেকে অভিযোগ করেন যে তাঁর আগের কিছু লেখার ঘটনাগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এই উপন্যাসে। তবে আমার মনে হয় যে মানুষ যেহেতু একজন, এবং তাঁর একটিই জীবন, সেখানে পুনরাবৃত্তি তো ঠেকানো যায় না।
কিন্তু আমার অতৃপ্তি অন্য জায়গায়। সুনীলবাবু তাঁর জীবনের এত গল্প লিখলেন, তবে তিনি কেন তাঁর কাকাবাবু সিরিজ বা সেই সময় প্রথম আলো উপন্যাসগুলো লেখার সময়টা, সেই সময়ে তিনি কিভাবে পড়াশোনা করে এই মহান সৃষ্টিগুলো করে গেলেন সেই গল্পটা আমাদের বলে গেলেন না? আরেকটা দ্বিতীয় পর্ব নিয়েও তো আসতে পারতেন!
তবুও বলবো এটা যেকোনো পাঠকের ভালো লাগার মত একটি বই।
"নীরা, আমাদের ভুল ভেঙে যায়, আমরা ফের বালি দিয়ে ছোট ছোট দুঃখের ঘর বানাই।"
আমরা যারা টুকটাক বই নিয়ে থাকি, তারা কমবেশি সবাইই সুনীলের কবিতার সাথে পরিচিত। কিন্তু আমি বেড়ে উঠেছি সুনীল বাবুর উপন্যাস পড়তে পড়তে।
জার্নালিং শব্দটার সাথে আধুনিকতার যোগসূত্র তৈরি হওয়ার আগেও তো মানুষের জীবনে নিত্যদিনের গল্প জমতো। কেউ সেই গল্প টুকে রাখতেন, আর কেউ কাগজে না লিখে আগলে রাখতেন নিজের মধ্যে। কেউ কেউ আবার শেষ বয়েসে এসে ভাবতেন একটা আত্মজীবনী লিখে ফেলা যাক!
অর্ধেক জীবনের ভূমিকাতে সুনীল লিখেছেন, পুরো জীবনের কথা তো কেউ কখনো লিখতে পারে না। তেমনি অর্ধেক জীবনও যেমন মাঝপথে হুট করে শেষ হয়ে গিয়েছে মনে হয়, আসলে তেমনটি নয়। লেখক ততটুকুই লিখেছেন যতটুকু তার পূর্বপরিকল্পিত ছিলো। পাঠককে শুধু দেখাতে চেয়েছিলেন তার জীবনের অনিশ্চিত সংগ্রামটুকু।
সুনীল বাবুর লেখা সর্বদাই সুখপাঠ্য। অর্ধেক জীবন পড়ে জানলাম, অপর্ণা, মার্গারিটা কিংবা স্বাতী নয়, কবিতাই ছিলো তার প্রথম প্রেম। যে প্রেম টিকিয়ে রাখতে যৌবনে তিনি পাগলামিও খুব একটা কম করেন নি।
যখন খুব ছোট ছিলাম,তখন আমাকে পটেটো চিপস কিনে দিলে;সেটা ভেঙে গুড়ো করে ফেলতাম। কারণ, গুড়ো করলে টুকরো সংখ্যা বাড়বে,দীর্ঘ সময় খাওয়া উপভোগ করতে পারবো এমনটাই ছিল ভাবনাতে। বড় হয়ে ও অভ্যাসটা আমার মধ্যে রয়ে গেলো,যদিও চিপস আর গুড়ো করি না কারণ এতে লস হয় বেশিই !
অর্ধেক জীবন পড়তে নিয়েছিলাম মাস খানেক আগে আর কিনেছিলাম তারও বছর খানেক আগে। বইটা দীর্ঘ সময় ধরে পড়ার কারণ হচ্ছে এটা ভীষণ ভালো একটা বই আর ভালো জিনিস ধীরে খাওয়া আমার পুরোনো অ���্যাস। পৃথিবী এক বিচিত্র গ্রহ, তার ভেতরে থাকা মানুষ গুলোর জীবন আরো বিচিত্র। একজন লেখক কিভাবে লেখক হয়ে উঠেন, তার চাইতে বড় যে বিষয়টা এই বইয়ে আছে তা হলো বৈরী পরিস্থিতিতে ও কীভাবে নিজের সাধনার প্রতি দৃঢ় থাকতে হয়। ফরিদপুরের অজ গাঁয়ের সনাতন হয়ে উঠে সুনীল,এ এক বিচিত্র ইতিহাস।