একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর দ্বারা সংঘটিত নারী নির্যাতনে পিষ্ট ক্ষতিগ্রস্তদের জবানবন্দির ভিত্তিতে লিখিত দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই গ্রন্থ। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে দেশের বিয়াল্লিশটি জেলার পঁচাশিটি থানার অসংখ্য সাক্ষাৎকারের মধ্যে থেকে বেছে বেছে নেয়া বাহাত্তরটি সাক্ষাৎকার। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নির্যাতিত নিম্মবিত্ত সাধারণ নারী, গ্রাম্য গৃহবধূ এবং বিভিন্ন উপজাতি, আদিবাসী ও চা শ্রমিক। এই সাক্ষাৎকারদাতা নারীদের বেশিরভাগই পাকিদের পাশবিক আক্রমণ ও যৌন নির্যাতনে ছিন্নভিন্ন হয়েছিলেন। সংগত কারণেই সাক্ষাৎকারে এরকম ক'জন ধর্ষিত নারীর নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে যুদ্ধের ন'মাসে ভারত ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী নির্যাতিত শরণার্থী নারীদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান। বিশ্লেষণের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে যে এই বিপুল সংখ্যাক শরণার্থীর মদহ্যে শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এক লাখ ত্রিশ হাজারেরও বেশি নারী পাকিদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। এছাড়া দেশের মধ্যে নির্যাতিত নারীদের পরিসংখ্যান তো রয়েছেই। সামগ্রিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, একাত্তরের ন'মাসে সাড়ে চার লাখেরও বেশি নারী পাকিদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে শতকরা ৫৬.৫০ ভাগ মুসলিম, ৪১.৪৪ ভাগ হিন্দু এবং ২.০৬ ভাগ খৃষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের। আরও উদঘাটিত হয়েছে যে যৌনদাসী, কমফোর্ট গার্ল ও সন্তানসম্ভবা অধিকাংশ যুদ্ধশিশুর মায়েরাও ছিলেন এই সম্প্রদায়ভুক্ত। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নির্যাতিত নারীর শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলোসহ সামাজিক জটিলতাও উঠে এসেছে এই গবেষণায়।
দেশে দেশে যুদ্ধে নারীর বিপন্নতা এবং নারী নির্যাতনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এর সঙ্গে একাত্তরের পাকিদের নারী নির্যাতনের ধরন ও মনোবিকার, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া নারীদের দুঃসহ জীবন, নারীর বৈষম্য, মানসিক বিপর্যয় ও জীব্বনের সংকট ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ব্যর্থতার বিষয়গুলো অনুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ডা. এম এ হাসান মূলত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক এবং কৌতুহলোদ্দীপক। তাঁর গবেষণার বিষয় 'অরিজিন অব লাইফ' থেকে 'ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন', মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনোলজি ও টক্সিকোলজিসহ নানা বিষয়ে বিস্তৃত। তিনি আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধে তাঁর উদ্ভাবিত নানা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন। দূষণের কারণ হিসেবে জলাবদ্ধতা ও অণুজীবের ভূমিকা তিনিই প্রথম শণাক্ত করেছেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সন পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এলার্জি ও এজমার উপর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্টাডিটি চালিয়েছেন। এইডস এপিডেমিওলজি ও এইচআইভি ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে তাঁর গবেষণা ব্যাপক। এইডস প্রতিরোধক একটি ওষুধও উদ্ভাবন করেছেন তিনি। তাঁর এসব কাজ রিভিউ করেছেন আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ এবং আমেরিকান হেলথ ডিপার্টমেন্টের এইডস ডিভিশনের বিজ্ঞানীরা।
'৭১ এর গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও বর্বরতার ডকুমেন্টেশন 'যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ' ও 'যুদ্ধ ও নারী' তাঁর দু'টি শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে 'নীরবতার ওপারে কৃষ্ণ মেঘের দিনগুলি', 'প্রসঙ্গ '৭১ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ', 'পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ১৯১ জন', 'লাপিস লাজুলি ও আমাদের ফুলের মেয়েরা', 'এইডস বিষয়ক মৌলিক প্রশ্ন ও মাঠ পর্যায়ের গবেষণা'। 'নৈঃশব্দের পদাবলী' তাঁর একক কাব্যগ্রন্থ।
অগুনতি শহীদ আর বীরাঙ্গনার রক্তে ভাসমান এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ বিস্মৃত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ এখন শুধুই "নষ্ট রাজনীতি"। পাকিরা আজও অনুতপ্ত নয়, তারা ক্ষমা চায়নি, কিন্তু নষ্ট বুদ্ধিজীবি ও শিল্পীগোষ্ঠীর নেতৃত্বে বাঙ্গালী তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচে পাকি ক্রিকেটার ক্যাচ ধরলে কিংবা ছক্কা হাঁকালে মহল্লার পর মহল্লা হর্ষধ্বনিতে কেপে উঠে। চৌকস চিন্তকরা এখন পুনর্মিত্রার বয়ান ফাঁদে। এহেন অবস্থায় এই বইয়ের প্রয়োজন আছে। ৩০০ পৃষ্ঠার এই বইটির প্রতিটি পাতায় গ্রামের পর গ্রাম ধর্ষণ করা, লাখে লাখে গর্ভপাত ঘটানো, দাঁতের দংশনে কিংবা সঙ্গিনের খোঁচায় স্তন কেটে ফেলা, যৌনাঙ্গের ভেতরে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি করা, কাপড় কাচার মতো করে আছাড় মেরে শিশুদের খুন করা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মা-বোনের চুল-আঙ্গুল-চামড়া-কাপড়ের টুকরোর বৃত্তান্ত পড়ার দরকার আছে। ইতিহাসের জারজ সন্তান হলে বাংলাদেশের পরিণতিও হবে পাকিস্তানের মতোই - আস্তাকুড়ে।