মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নীলগঞ্জে হঠাৎ পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর আগমন, বাংলাদেশের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতার আভাস দিয়েছেন লেখক। ছোট্ট পরিসরের উপন্যাসে উত্তাল রণাঙ্গনের বর্ণনা নেই। আছে গ্রামের নিরীহ বাঙালিদের অসহায়তা। উপন্যাস শেষে পাকিস্তানি মেজরের বাঙালি সহকারীর উক্তি "রফিক তীক্ষ্ণস্বরে বলল- মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এ দেশ থেকে!" লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়ে গেছে।
Humayun Ahmed (Bengali: হুমায়ূন আহমেদ; 13 November 1948 – 19 July 2012) was a Bangladeshi author, dramatist, screenwriter, playwright and filmmaker. He was the most famous and popular author, dramatist and filmmaker ever to grace the cultural world of Bangladesh since its independence in 1971. Dawn referred to him as the cultural legend of Bangladesh. Humayun started his journey to reach fame with the publication of his novel Nondito Noroke (In Blissful Hell) in 1972, which remains one of his most famous works. He wrote over 250 fiction and non-fiction books, all of which were bestsellers in Bangladesh, most of them were number one bestsellers of their respective years by a wide margin. In recognition to the works of Humayun, Times of India wrote, "Humayun was a custodian of the Bangladeshi literary culture whose contribution single-handedly shifted the capital of Bengali literature from Kolkata to Dhaka without any war or revolution." Ahmed's writing style was characterized as "Magic Realism." Sunil Gangopadhyay described him as the most popular writer in the Bengali language for a century and according to him, Ahmed was even more popular than Sarat Chandra Chattopadhyay. Ahmed's books have been the top sellers at the Ekushey Book Fair during every years of the 1990s and 2000s.
Early life: Humayun Ahmed was born in Mohongonj, Netrokona, but his village home is Kutubpur, Mymensingh, Bangladesh (then East Pakistan). His father, Faizur Rahman Ahmed, a police officer and writer, was killed by Pakistani military during the liberation war of Bangladesh in 1971, and his mother is Ayesha Foyez. Humayun's younger brother, Muhammed Zafar Iqbal, a university professor, is also a very popular author of mostly science fiction genre and Children's Literature. Another brother, Ahsan Habib, the editor of Unmad, a cartoon magazine, and one of the most famous Cartoonist in the country.
Education and Early Career: Ahmed went to schools in Sylhet, Comilla, Chittagong, Dinajpur and Bogra as his father lived in different places upon official assignment. Ahmed passed SSC exam from Bogra Zilla School in 1965. He stood second in the merit list in Rajshahi Education Board. He passed HSC exam from Dhaka College in 1967. He studied Chemistry in Dhaka University and earned BSc (Honors) and MSc with First Class distinction.
Upon graduation Ahmed joined Bangladesh Agricultural University as a lecturer. After six months he joined Dhaka University as a faculty of the Department of Chemistry. Later he attended North Dakota State University for his PhD studies. He grew his interest in Polymer Chemistry and earned his PhD in that subject. He returned to Bangladesh and resumed his teaching career in Dhaka University. In mid 1990s he left the faculty job to devote all his time to writing, playwright and film production.
Marriages and Personal Life: In 1973, Humayun Ahmed married Gultekin. They had three daughters — Nova, Sheela, Bipasha and one son — Nuhash. In 2003 Humayun divorced Gultekin and married Meher Afroj Shaon in 2005. From the second marriage he had two sons — Nishad and Ninit.
Death: In 2011 Ahmed had been diagnosed with colorectal cancer. He died on 19 July 2012 at 11.20 PM BST at Bellevue Hospital in New York City. He was buried in Nuhash Palli, his farm house.
আগুনের পরশমণি আমার সবচেয়ে প্রিয় হুমায়ুন আহমেদের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস হলেও স্বীকার করতেই হয় উনার লেখা ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডিস্টার্বিং বই আমার কাছে সবসময় ১৯৭১। বইটা আমি ২-৩বারের বেশি পড়ি নাই, কিন্তু আমার প্রতিটা ভয়ানক ঘটনাবলী এখনো মাথায় পরিষ্কার গেঁথে আছে ডায়লগ সহ! হয়তো একারণেই এই বইটা আমার 'প্রিয়' মুক্তিযুদ্ধ বা এমনকি 'প্রিয়' হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের তালিকাতেও আসবে না, কারণ এটা সত্যের খুব কাছাকাছি... আর রঙ্গিন কল্পনাবিলাসি পাঠক হিসেবে আমি হয়তো আপনা থেকেই সবসময় চেষ্টা করি ধুলো-ধুসরিত কঠোর বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে।
উপন্যাসটি পড়ে মনে হচ্ছে , অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আরেকটু বড় পরিসরে যদি লেখক কাহিনীটাকে সাজাতেন তাহলে হয়ত আরও ডিটেইলে একাত্তরকে উপস্থাপন করা যেত।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসসমূহের মধ্যে '১৯৭১' কখনোই অন্যতম সেরা নয়। তারপরও লেখক এই উপন্যাসের মাধ্যমে একাত্তরে সাধারণ বাঙালীর অবস্থান এবং হানাদারদের নিষ্ঠুরতাকে কিছুটা হলেও বইয়ের পাতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন।
নীলগঞ্জ গ্রামের পটভূমিতে একাত্তরের কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। সেসব খন্ডচিত্রকে একত্রিত করে পাঠকের পক্ষে সম্ভব হবে একাত্তর সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করা।
১. হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা বেশ বড়। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা হলেও বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা সাহিত্যকর্মের সংখ্যা হাতে গোণা। সেই অল্প ক’টি সাহিত্যকর্মের একটি ‘১৯৭১’। বইটির বিপণন করা হয়েছে একটি উপন্যাস হিশেবে, যদিও একে ‘উপন্যাস’এর গোত্রভুক্ত করা যায় কিনা তা নিয়ে আমি নিচে আলোচনা করেছি। হুমায়ূন আহমেদ বিচিত্র বিষয়ে উপন্যাস, গল্প লিখেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ এখনো বাংলাদেশে করা হয় নি; এলিট সাহিত্য-সমালোচকদের কাছে তিনি অপাঙতেয় হয়ে রয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাসের প্রতি সমালোচকদের বিশেষ মনোযোগ প্রদান অতি-আবশ্যক, কেননা বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে মানুষ এখনো ইতিহাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা ইতিহাসের ভিন্ন ডিসকোর্সের জন্য প্রস্তুত নয়। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক আরেকটি বৃহৎ উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ যেভাবে সাহিত্য-বিশ্লেষকদের মনোযোগ পেয়েছে, অন্যগুলো তেমনিভাবে পায় নি।
২. হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ‘১৯৭১’ উপন্যাসের পটভূমি হিশেবে বেছে নিয়েছেন বিচ্ছিন্ন একটি ছোট্ট গ্রাম, নীলগঞ্জকে। ময়মনসিংহ-ভৈরব লাইনের ছোট স্টেশন থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরের গ্রাম নীলগঞ্জ, যেখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন রিকশা,তাও গ্রীষ্মকালে; বর্ষাকালে কাঁদা ভেঙ্গে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তৎকালীন জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এমন এক নির্জন গ্রাম কেন বেছে নিলেন লেখক- এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে। আলোচ্য উপন্যাসে লেখকের মূল আগ্রহ ছিল, গ্রামে মিলিটারি আগমনের ফলে গ্রামের মানুষগুলোর মনো-জাগতিক কম্পন পাঠকের সামনে তুলে ধরা। সে কারণেই হুমায়ূন আহমেদ একটি ছোট গ্রামীণ সমাজ বেছে নিয়েছিলেন। এছাড়া লেখকের বাড়ি ময়মনসিংহ অঞ্চলে হওয়ার কারণে ওখানকার মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ভাষার সাথে খুব ভালোভাবে পরিচয় আছে তাঁর। ধারণা করি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসটিতে তিনি তাঁর কমফোর্ট জোনে থাকতে চেয়েছেন।
উপন্যাসের বেশ অনেকটুকু জুড়েই লেখক গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন, বেশিরভাগই আশপাশের পরিবেশ নিয়ে। মানুষের জীবিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে লিখেছেন, “জমি উর্বর নয় কিংবা এরা ভালো চাষী নয়। ফসল ভালো হয় না। তবে শীতকালে এরা প্রচুর রবিশস্য করে। বর্ষার আগে করে তরমুজ ও বাঙ্গি”। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরবর্তীতে অপর একটি স্থানে ফসল সম্পর্কিত আরেকটি তথ্য লেখক দিয়েছেন যা পূর্বে প্রদত্ত তথ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গল্পের সমস্ত ঘটনা ঘটেছে বৈশাখের একটি দিনে, যেদিন গ্রামে মিলিটারি হানা দেয়। গ্রামবাসীর দৈনন্দিন কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, “উত্তর বন্দে বোরো ধান পেকে আছে। দক্ষিণ বন্দে আউশ ধান বোনা হবে”। লেখক নিজের দেয়া তথ্য ভুলে গিয়ে অন্য একটি তথ্যের যোগান দিয়েছেন, যা না দিলেও গল্পের কোনো ক্ষতি হতো না। ভুলটুকু হুমায়ূন আহমেদের বাক্যে বাক্যে গল্প তৈরির প্রবণতার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আরো একটি ভুল করেছেন লেখক। নীলগঞ্জ হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রাম যেখানে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে নি। এদিকে বোরো ধান হলো শীতকালে আবাদযোগ্য ধান যার জন্য সেচের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বেশিভাগ এলাকাতেই বোরো ধানের আবাদ আশির দশকের পূর্বে শুরু হয় নি, কারণ বেশিরভাগ এলাকাই বিদ্যুৎ-বঞ্চিত ছিল। লেখক ইতিহাসের একটি বিশেষ সময় নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে সেকালের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পুনঃ-সৃষ্টি করতে গিয়ে কয়েকটি ভুল করেছেন।
আরো অসঙ্গতি আছে। নীলগঞ্জে মিলিটারি আসে বৈশাখ মাসে। নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা না হলেও ধারণা করা যায়, ঘটনা ঘটেছে বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে। কেননা লেখকের ভুলক্রমে উল্লেখিত বোরো ধান কাটার সময়টা সাধারণত বৈশাখে শুরুতেই এসে যায়। একাত্তরে বৈশাখ মাস অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে উপন্যাসের নীলগঞ্জে মিলিটারির আগমন ঘটে। ব্যাপারটি ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে খাপ খায় না, কারণ সে সময়ে পাকিস্তানি মিলিটারি শুধুমাত্র বড় শহর এবং জেলা শহর-গুলোয় পৌঁছেছিল। নীলগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে তাদের আরো কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ যে তেমন কোনো গবেষণা ছাড়াই উপন্যাস লিখতে বসেছেন তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় এই উপন্যাসে রাজাকার বাহিনীকে যুক্ত করায়। উপন্যাসে মিলিটারিকে সাহায্য করার জন্য রাজাকারদের একটি দল নীলগঞ্জে আসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজাকার বাহিনী সেসময়ে গঠিতই হয় নি। রাজাকার বাহিনী প্রথম গঠিত হয় খুলনায়, মে মাসে। রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি হয় জুন মাসের ১ তারিখ। রাজাকারদের ১৫ দিনের একটি ট্রেনিং-এ অংশ নেয়া ছিল বাধ্যমূলক। অতএব, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় যে, এপ্রিল-মে মাসে রাজাকারের একটি বড় দল ময়মনসিংহের নীলগঞ্জে এসে উপস্থিত হবে। হুমায়ূন আহমেদ ঐতিহাসিক টাইমলাইনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন নি কিংবা থাকার প্রয়োজন বোধ করেন নি।
৩. ‘১৯৭১’ উপন্যাসে বেশ কিছু চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে; যাদের বেশিরভাগই গ্রামের সাধারণ মানুষ। অন্ধ বুড়ো মীর আলি এবং তার পুত্র ব্যবসায়ী বদিউজ্জামানকে নিয়ে গল্প শুরু হলেও মূল উপাখ্যানে তাদের কোনো অবদান নেই। তাদেরকে মূলত পাঠকের মনোযোগ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতেই গল্পে আনা হয়েছে। এটি হুমায়ূন আহমেদের একটি রচনাকৌশল; শুরুতে যে চরিত্রের বিকাশে বেশি সময় ব্যয় করা হয় সে চরিত্র গল্পের ফলাফলে কোনো প্রভাব রাখে না। গ্রামবাসীদের মধ্যে আরো দু’টি চরিত্র গল্পের অনেকটা জায়গা দখল করেছে- নীলগঞ্জ স্কুলের শিক্ষক আজিজ মাস্টার এবং মসজিদের ইমাম সাহেব। মিলিটারি গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমেই তাদেরকে আটক করে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। লেখক তাদের মাধ্যমে পাক-মিলিটারির জিজ্ঞাসাবাদের ধরণ তুলে ধরতে চেয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় যে আতঙ্ক এবং জীবননাশের আশঙ্কা মানুষ অনুভব করত, তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ।
এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি চরিত্র হলো মেজর এজাজ আহমেদ এবং তার সহযোগী রফিক। মেজর এজাজ আহমেদ মিলিটারির একটি ছোট দল নিয়ে নীলগঞ্জে প্রবেশ করে। তাকে ফিফটি এইটথ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার হিশেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি এই উপন্যাসের আরেকটি তথ্যগত ভুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারির ফিফটি এইটথ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের কোনো সৈন্যদল যুদ্ধে কিংবা অভিযানে অংশ নেয় নি। প্রকৃতপক্ষে একাত্তরে পাকিস্তান মিলিটারিতে এই নামের কোনো ব্যাটালিয়নের অস্তিত্ব ছিল না (এবং এখনো নেই)। কাল্পনিক গল্প নিয়ে উপন্যাস লেখার সময় সব ক’টি তথ্যই একেবারে নির্ভুল হতে হবে তার দিব্যি কেউ দেয় নি, কিন্তু নিকট অতীতের একটি উল্লেখযোগ্য সময় নিয়ে লেখার সময় প্রদত্ত তথ্যগুলো ভালোভাবে যাচাই করে নেয়া লেখকের দায়িত্ব। অন্যদিকে রফিকের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না গল্প থেকে। শুধু জানা যায়, সে একজন শিক্ষিত যুবক; তার বাড়ি কোথায় কিংবা পেশা কী তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় না। উপন্যাসের শুরুতে তাকে নেহাতই সাধারণ চরিত্র মনে হলেও গল্প যতোই ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগুতে থাকে ততোই তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। ক্লাইম্যাক্সের মোচড়টা মূলত সে-ই নিয়ে আসে। হেলাফেলা করে তার চরিত্র নির্মাণ করে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পাঠকদেরকে একটি চমক দিতে চেয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন।
৪. মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো এলাকায় পাকিস্তানি মিলিটারির আগমনের ফলে এলাকাবাসীর নিস্তরঙ্গ জীবনে যে ঝড় বয়ে যেত তা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এক্ষেত্রে লেখকের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা দারুণ কাজে দিয়েছে বলেই ধারণা করি। নীলগঞ্জে মিলিটারি আগমনের খবরে গ্রামবাসীর প্রাথমিক অবিশ্বাস এটাই প্রমাণ করে যে, মিলিটারির আগমন বাঙালির জন্য কতোটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আতঙ্কজনক ছিল। নীলগঞ্জে মিলিটারি পদার্পণের পরিণতি শুরুতে টের পায় কৈবর্তরা। এরপর আজিজ মাস্টার এবং ইমাম সাহেবকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের ফলশ্রুতিতে গোটা গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। মিলিটারিরা গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নীলু সেনকে মেরে ফেলে রাখে তার বাড়ির সদর দরজায়। এছাড়া আর কোথাও কোনো বাড়িতে হামলা চালায় না মিলিটারি। ব্যাপারটি একটু অদ্ভুত। পাক মিলিটারির অপারেশনের যতো বর্ণনা আজ পর্যন্ত মিলেছে, তাতে গ্রামবাসীর প্রতি এতোটা সদয় থাকার মতো ঘটনা ঘটবার কথা নয়।
হুমায়ূন আহমেদ পাকিস্তানি মিলিটারির প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন- এমন মারাত্মক অভিযোগ করা সম্ভব নয়। তবে উপন্যাসের বর্ণনা এমনভাবে দেয়া হয়েছে যেন, তারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক কাজই করেছে। মিলিটারির দলনেতা মেজর এজাজ আহমেদ জানায় যে, মুক্তিবাহিনী তার বন্ধুকে মেরে ফেলেছে, তাই সে গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে এসেছে। এখানে সামান্যভাবে হলেও মেজরের কর্মকাণ্ড জাস্টিফাই করার চেষ্টা দেখতে পাই। উপন্যাসের এক পর্যায়ে মেজর তার সহচর রফিককে বলে, “রফিক, আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। সারভাইভালের প্রশ্ন। এই সময়ে অন্যায় কিছু হবেই। উল্টোটা যদি হতো- ধর বাঙালি সৈন্য আমাদের গ্রামে ঠিক আমাদের মতো অবস্থায় আছে, তখন তারা কী করত? বলো, কী করত তারা? যে অন্যায় আমরা করছি তারা কি সেগুলি করত না?” হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গল্পের পাকিস্তানি মেজরকে বুদ্ধিমান, অনুভূতিপ্রবণ ও বিবেক-বোধসম্পন্ন একজন মানুষ হিশেবে চিত্রিত করেছেন, যে নেহাতই পরিস্থিতির শিকার। নিরপেক্ষ কিংবা ভিন্ন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করলে ব্যাপারটি খুবই অনন্য। কেননা, একটা যুদ্ধে নির্যাতিত ও পিতাকে হারানো একজন লেখক পাকিস্তানি মিলিটারির একটি চরিত্রকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন- ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে।
লেখক যদিও মেজরের চরিত্রে মানবিক আঁচড় দিয়েছেন, কিন্তু বাঙালি সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে মনোভাব ছিল তা পুরোপুরি ধরে রেখেছেন, সার্থকভাবে। বাঙালিকে নিজেদের চেয়ে নীচু জনগোষ্ঠী ভাবা পাকিস্তানিরা বাঙালিকে কখনোই তাদের সমমর্যাদা দেয় নি- তা তো সবসময়ই প্রমাণিত ছিল। মেজরের কয়েকটি মন্তব্য তাদের মনোভাব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে- “তোমরা মাত্র পঁচিশ ভাগ মুসলমান, বাকি পঁচাত্তর ভাগ হিন্দু”, “বাঙালিদের মান অপমান বলে কিছু নেই। একটা কুকুরেরও আত্মসম্মান জ্ঞান থাকে, এদের তাও নেই”।
পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃক বাঙালি নারীদের নির্যাতিত হওয়ার প্রসঙ্গ এই গল্পে উঠে আসে নি। সফদরউল্লাহ’র বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রী ও কন্যাদের দিকে একজন মিলিটারি ও তিনজন রাজাকারের এগিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ আছে শুধুমাত্র। খুবই পরোক্ষভাবে নির্যাতনের ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক, যা যথেষ্ট নয়। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অন্যান্য গল্প-উপন্যাসেও পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকার কর্তৃক নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে উঠে আসে নি। হতে পারে তিনি বিষয়টি নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না; কিংবা এও হতে পারে যে, তাঁর বইয়ের পাঠকদের বেশিরভাগের বয়স কৈশোরের কোঠায় থাকায় তিনি তাঁর পাঠকদের কুৎসিত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অস্বস্তিতে ফেলতে চান নি।
৫. কলেবরের দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’ উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে না। যদিও উপন্যাস রচনার সার্বজনীন কোনো শব্দ বা পৃষ্ঠাসংখ্যা নির্দিষ্ট করা নেই, তবুও আমার মতে ‘১৯৭১’কে একটি সার্থক বড়ো গল্প গণ্য করা যেতে পারে। উপন্যাসের যে ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধারণত সফল উপন্যাসগুলোয় থাকে, তা এখানে অনুপস্থিত। তবে তাই বলে ‘১৯৭১’ ব্যর্থ রচনা নয়। একাত্তরের অদ্ভুত সময়টা দু’মলাটে বন্দী করা খুব সহজ কাজ নয়- এটা মাথায় রেখেই বলতে হয় হুমায়ূন আহমেদ বেশ খানিকটা সফল হয়েছেন। কিছু ভুল ভ্রান্তি বাদ দিলে, ‘১৯৭১’ কে হুমায়ূন আহমেদের উল্লেখযোগ্য কাজ হিশেবে গণ্য করা যায়। বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষা এই উপন্যাসে অত্যন্ত সু-নিপুণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণের একটা উদাহরণ এখানে উল্লেখযোগ্য- “নান্দাইল রোড থেকে রুয়াইল বাজার আসতে বেলা পুইয়ে যায়”।
উপন্যাসের নাম "১৯৭১"। কিন্তু আমরা মাত্র একটা দিনের ঘটনা পড়ি, তাও বাংলাদেশের একটা অজপাড়াগাঁয়ের। তারপরও ঐ ঘটনাবহুল একটা দিনের প্রতি আলোকপাত করলে মুক্তিযুদ্ধের নয়টা মাস সমগ্র বাংলাদেশের নিরীহ মানুষদের অবস্থা কেমন ছিল তার একটা ছবি পাওয়া যায়।
উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার। এই লোকটা মানুষকে নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়ে তৃপ্তিলাভ করে। এই অফিসারের কাহিনী পড়ে Schindler's List মুভির নাজি অফিসার Amon Goeth এর কথা মনে পড়ছিল। মুভিটার কাহিনী ভালো মনে নেই, তবে সে লোকটাও ভয়াবহ নিষ্ঠুর ছিল।
পাকিস্তানিদের নৃশংসতা, অসহায় বেসামরিক বাঙালিদের দুর্দশা, হিন্দু জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে হত্যা ও উচ্ছেদ, নারীদের যৌন নিপ���ড়ন, এসবকিছুই ১৯৭১ উপন্যাসে স্বচ্ছতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মুক্তিবাহিনীর কথা এই উপন্যাসে নেই, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ভয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের স্নায়ুর চাপটা আমরা অনুভব করতে পারি।
দারিদ্র্যে জড়জড়িত গ্রাম নীলগঞ্জ। হঠাৎই আগমন ঘটে মিলিটারিদের। শান্ত প্রান্তরে আগুন জ্বলে ওঠে, একের পর এক লাশ পড���তে থাকে, আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে যায়। পাকবাহিনীর নিরীহ বাঙালিদের উপর নির্যাতনের চিত্র দেখানো হয়েছে। সময়টা আসলে বলতে গেলে যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধারা প্রাণ দিচ্ছে এমন কাহিনী আমরা কমবেশি বিভিন্ন যুদ্ধভিত্তিক বইয়ে পড়েছি। কিন্তু এখানে দেখানো হয়েছে পরোক্ষ যুদ্ধ। যোদ্ধাদের বাঁচাতে অসহায়, নিরীহ গ্রামবাসীরাও জীবন দিচ্ছে। রফিক চরিত্রটা বেশ রহস্যময়। পড়া শেষে মনে হয়েছে যুদ্ধ আসলে সেসময় সবাই-ই করেছে। কিন্তু যুদ্ধের প্রকৃতি ভিন্ন।
নীলগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্থানির বর্বরতা তুলে এনেছেন লেখক। এতো দারুণ ভাবে শুরু হয়ে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা আক্ষেপ রয়ে যাবে। রফিক চরিত্র অনেক কিছু বলে যায়।
লেখক মাত্র একটি দিনকে জুড়ে লে খাটির সমগ্র উপন্যাসিকার প্রেক্ষাপট অপূর্বভাবে সাজিয়েছেন।
নীলগঞ্জ নামের হতদরিদ্র একটি গ্রামে একাত্তরের একদিন হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা উপস্থিত হয়। সাথে থাকে রকিফ নামের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। আর ঐদিন ঘটে চলে তাদের একের পর এক বর্বরতা। কিন্তু নীলগঞ্জের রাত্রি তার গাঢ় অন্ধকার নিয়ে অপেক্ষা করছিল অন্যকোন গল্পের। গল্পটা ছিল যুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের।
যারা ইতিহাসের মাত্র একটি পাতায় সমগ্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপর চোখ বুলাতে চান তাদের কাছে বইটি থাকবে স্মরণীয় হয়ে
১৯৭১ সাল এমন একটি সময়, যে সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত একেকটা গল্পের সাক্ষী। ভয়ে, আতঙ্কে সময় পার করেছে বেশিরভাগ মানুষ। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ কত কী না করে! অন্যদিকে নিজেদের অস্তিত্ব জিইয়ে রাখতে হন্যে হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বেরিয়েছে পাক বাহিনী। নাম নিশানা মুছে দিতে হবে মুক্তিযোদ্ধা নামের দেশদ্রোহীদের।
হুমায়ূন আহমেদের '১৯৭১" আহামরি কোনো গল্প নয়। লেখক এমনই এক গল্প বলতে চেয়েছেন কেবল। একটি গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবন বদলে যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। হয়তো তারা সরল, তারা গরীব। কিন্তু তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর মমতা আছে। তাই তাদের ছায়ায় গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে মুক্তি বাহিনী। তাদের খুঁজতেই যেন গ্রামে পা পড়েছে হানাদার বাহিনীর। সাথে কিছু রাজাকার। পাক বাহিনী যেখানে পা দেয়, সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কপালে কী আছে সেসব সাধারন মানুষের?
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় দুটি বিষয় আমার দারুণ লাগে। প্রথমটি হলো, তিনি তার লেখায় যে বর্ণনার আশ্রয় নেন খুব বেশি বাস্তব বলে মনে হয়। মনে হয়, এমনই তো হওয়ার ছিল। এই যে জীবনের সাথে গল্পের এক সংযোগ স্থাপন হুমায়ূন আহমেদ করতে পারতেন, সেজন্য তিনি অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, কিন্তু কোনো যুদ্ধের বর্ণনা নেই। অথচ কী দারুণভাবে এর ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে।
আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, লেখক চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা না করলেই যেন চরিত্রগুলো খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে! যেমন পাক বাহিনীর মেজর! তার নিষ্ঠুরতা এমন নিদর্শন রেখে গিয়েছে, যা দেখলে পিলে চমকে যায়। তাই বলে তিনি মানুষটা তেমন? যুদ্ধের গল্পে প্রবেশ করলে নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হয়। যা প্রতিপক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ, সেই কাজ করলে যেন বিজয়ের কাছে পৌঁছানো যায়। কিংবা রফিক! রাজাকার হয়ে থাকা ছেলেটার মনের মধ্যে কী আছে? যতই ভিনদেশীদের সমর্থন জুগিয়ে চলুক, দেশ মাতৃকার সন্তানদের জন্য টান যে অনুভব করতে হয়!
শেষটা টিপিকাল হুমায়ূন আহমেদের অন্য সব বইয়ের মতো। সমাপ্তি ভেবে নেওয়ার যে সুযোগ লেখক রেখেছেন সেটা কি যৌক্তিক? হয়তো খুব ভালো কিছুর সমাপ্তি নিশ্চয়ই ভাবা যায়, কিন্তু সবাই জানে... সেই বিষাদের ছোঁয়াতেই যেন গল্পের শেষ।
▪️বই : ১৯৭১ (১৯৯১ সালের সংস্করণ) ▪️লেখক : হুমায়ূন আহমেদ ▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৪/৫
হুমায়ূন আহমেদের লেখা মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বইগুলোর চেয়ে এটা কিছুটা ভিন্ন। খুব ছোট্ট কলেবরের বই। তাই স্বাভাবিকভাবেই চরিত্রগুলো গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তাতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, বইটি উপভোগ্য ছিলো।
নীলগঞ্জ গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষের বাস। একাত্তরের সময়টাতে বাংলাদেশের অন্য সব গ্রাম গুলোর মত এখানেও পাকিস্তানের সৈন্য এসে গ্রামের স্কুলে ঘাঁটি করে এবং এদের সাথে থাকে এদেরই কিছু মানুষ রুপের রাজাকার। পুরো নয় মাস যুদ্ধের মাত্র কয়েক ঘন্টার পৈশাচিক , নির্মমহত্যা ও অত্যাচারেরে একটা খন্ডচিত্র মাত্র এই বই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে লেখা যেমন হয় তেমন সব ঘটনা নিয়ে ছোট্ট এই বইটা। আরও একটু বড় হতে পারতো, কাহিনি বড্ড তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়েছে মনে হয়েছে।
বইটি পড়ার যে লাভ পেয়েছি তা হল পড়ার সময় বেশ কয়েকটি মানস পরীক্ষণ খেলে গেছে মনে। কোরআন কায়েদা পড়ার জন্য ছোটবেলায় সিন ব্যবহার করানো হত। পয়েন্টারের মত কাজ, লাইনের উপর দিয়ে ধরে ধরে পড়ার। আমি একটি আরবি শপিং প্যাকেট কেটে তৈরি করেছিলাম আমার দুটো সিন। বলাবাহুল্য, সে দাঁতপড়া বয়সে আরবি হরফওয়ালা সিন দেখে সিনকেও অতিপবিত্র কিছু মনে হত। পাকি আমলের আগেই উর্দু আমাদের শিক্ষাক্রমে ঢুকে হয়তোবা মগজে উর্দুভাষীদের জন্য একটা স্থান করে দিয়েছিল। বাঙালির মস্তিষ্ক ব্যাকটেরিয়া এবং উর্দু যেন ভাইরাস, আর ধর্মচর্চার উর্দুসাহিত্য ধর্মকে পড়ার ডিএনএ ট্রান্সক্রিপশন - এই দুইয়ে দীর্ঘকাল কেমন করে জানি ব্যাকটেরিয়া মস্তিষ্কে স্বভাবজাত করে তুলেছিল যে- পাকিরা সাচ্চা মুসলমান! এই সাচ্চারা আবার আমরা সাচ্চা কি না তা বুঝতে নুনু দেখা লাগত! বুঝেন। কি অবস্থা! ধর্ম যেন অঙ্গে লেখা। মুসলমান দেহ এবং ইসলামের অবয়বের ফাঁক ঐ ভাইরাসেই খোয়া গিয়েছে। আরবিতেও গালি হয়, মুসলমানেও ফায়দাওয়ালার অভাব নাই। বেকুব হই আমরা সবাই। সব সময়ে। আজ কতটা বেকুব সেটা বলবে পরের প্রজন্ম।
পুরো গল্পটা জুড়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রফিককে রাজাকার হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বারবারই মন বলেছে মুদ্রার ওপিঠের কাহিনীটা ঠিক অন্য.স্বাধীনতা শব্দটা ঠিক এরকম কিছু মানুষের জন্যই আজ মুক্তভাবে উপভোগ করা যায়, নিঃশ্বাসের শব্দের মত শোনা যায়,ভোরের নরম আলোর মত গায়ে মেখে আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বের মত ঘোরাও যায়
’৭১ এ পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন হুমায়ূন আহমেদের বাবা। তাদের প্রতি তার ঘৃণা থাকাটাই স্বভাবিক। তার এই ঘৃণার মাত্রাটা কিছুটা হলেও বোঝা যায় এই বইটা থেকে। বইটা খুব ছোট। তবে এই ছোট পরিসরে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা এক কথায় পৈশাচিক।
Somewhat beautiful and did not like anything. Rafiq is the first hatred on the character, but after a respect has developed. Just say this, Humayun Ahmed compared himself,
ছোট কলেবরের একটা গল্প। মজার বিষয় হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদ বইয়ের নাম দিয়েছেন ১৯৭১, যেটা একটা পুরো বছর কে নির্দেশ করে। কিন্তু গল্পের বিস্তার একদিন। তবে একদিনের বর্ননায় উঠে এসেছে ঐসময় কতটা আতঙ্কে মানুষ দিনাতিপাত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক আগ্রহ থাকলেও খুব বেশী পড়া হয়নি। তবে যতগুলো পড়েছি তার সাথে তুলনা করলে এখানে কিছু পার্থক্য দেখতে পাই। হুমায়ুন আহমেদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন, পাকিস্তানিদের প্রতি তার সহানুভূতি না থাকা খুবই স্বাভাবিক। এরপরেও এখানে মেজর এজাজের যে চরিত্র তিনি রেখেছেন তাকে যথেষ্ট অনুভূতিশীল মনে হয়েছে। একই সাথে তার নিষ্ঠুরতারও যথার্থ উদাহরণ আছে।
অন্য অনেক মুক্তিযুদ্ধের গল্পের মতো এখানে হুজুরদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখানো হয়নি।
রফিকের চরিত্রটি খুব ইন্টারেস্টিং, লেখক খুব দুর্বলভাবে তার চরিত্র বিল্ডআপ করেছেন। তার সম্পর্কে খুব বেশি জানাও যায় না, তবে শেষের অংশে তাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে দেখা যায়।
বইঃ ১৯৭১ লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ শুরুটা হয় বদিউজ্জামানের অন্ধ বৃদ্ধ বাবাকে দিয়ে। নীলগঞ্জ গ্রামে মিলিটারিরা আসে। তাদের ধারনা পাশের জঙ্গলে মুক্তিবাহিনী আছে আর গ্রামের সবাই এই খবর জানে এমনকি তাদের সাহায্যও করে। মেজর এজাজ আর রফিক যে কিনা তার সহযোগী হিসেবে সাথে থাকে তাদের দুজনকেই মূল চরিত্র বলা চলে যদিও মাস্টার আর ইমাম সাহেবকে মূল চরিত্র ভেবে ভূল করেছিলাম। তাদেরকে ধরে আনা হয় যাতে করে তাদের থেকে মুক্তিবাহিনীর তথ্য নিতে পারে। মেজর এজাজ এর বন্ধুকে মুক্তিবাহিনিরা খুন করায় সে এই গ্রামে এসেছে। মাস্টার আর ইমামের ওপর নির্যাতন করে তাদের থেকে তথ্য নিতে চায় মেজর এজাজ। কিন্তু তারা কিছুই জানেনা কথাটি সত্য বলে রফিক তাদের সাপোর্ট করায় এজাজ রফিককে সন্দেহ করতে শুরু করে। এজাজ আরো বেশি কঠোর হয় আর রফিককেও শেষমেষ তার কঠোরতার শিকার হতে হয়। পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাল ১৯৭১। যদিও উপন্যাস নাকি বড় গল্প এই বিষয়ে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না তারপরেও উপন্যাস হিসেবে যদি ধরি, বইটি খুব বেশি সাড়া জাগানো নয় তবে বইটিতে একটি গ্রামের অবস্থার কথা তুলে ধরার মাধ্যমে সারা দেশের অবস্থার একটা আভাস লেখক আমাদের দিতে চেয়েছেন। বর্ননার মধ্যে অনেক অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ননা গুলোর একটু সংগতি দাবী করাই যায়।
মীর আলি চোখে দেখে না। আগে আবছা আবছা দেখত। দুপুরের রোদের দিকে তাকালে হলুদ কিছু ভাসত চোখে। গত দু বছর ধরে তাও ভাসছে না। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তাঁর বয়স প্রায় সত্তুর। এই বয়সে চোখ-কান নষ্ট হতে শুরু করে। পৃথিবী শব্দ ও বর্ণহীন হতে থাকে। কিন্তু তার কান এখনো ভালো। বেশ ���ালো। ছোট নাতনীটি যত বার কেঁদে ওঠে তত বারই সে বিরক্ত মুখে বলে, চুপ, শব্দ করিস না। মীর আলি আজকাল শব্দ সহ্য করতে পারে না। মাথার মাঝখানে কোথায় যেন ঝনঝন করে।
বদিউজ্জামান তাঁর বড় ছেলে। মধুবন বাজারে তাঁর একটা মনিহারী দোকান আছে। রোজ সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে সাত মাইল হেঁটে সে বাড়ি আসে। ছেলের বউ অনুফা তাঁর স্বামীকে জাগায় না। প্রায়দিন বুড়ো শ্বশুরকে বাথরুমে নিয়ে যেতে নিজেই উঠে আসে হাতে আলো নিয়ে।
পঞ্চাশ জন সৈন্যের ছোট একটা দল গ্রামে এসে ঢোকে। মার্চটার্চ না, এলোমেলোভাবে চলা। তাঁদের পায়ের বুটে কোনো শব্দ হয় না। তাঁরা যায় মীর আলির বাড়ির সামনে দিয়ে। এবং তাঁদের এক জন মীর আলির চোখে পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলে। মীর আলি কিছু বুঝতে পারে না। শুধু উঠোনে বসে থাকা কুকুরটা তারস্বরে ঘেউঘেউ করতে থাকে। মীর আলি ভীত স্বরে ডাকে, বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান। গ্রামের নাম নীলগঞ্জ। প���েলা মে। উনিশ শ একাত্তর। ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক এক জন মেজর—এজাজ আহমেদ। কাকুল মিলিটারি একাডেমির একজন কৃতী ক্যাডেট। বাড়ি পেশোয়ারের এক অখ্যাত গ্রামে। তাঁর গাঁয়ের নাম—রেশোবা।
দু জন বিদেশি লোক আছেন নীলগঞ্জে। এক জন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব। এত জায়গা থাকতে তিনি এই দুর্গম অঞ্চলে ইমামতি করতে কেন এসেছেন সে-রহস্যের মীমাংসা হয় নি। তিনি মসজিদেই থাকেন। মাসের পনের দিন জয়নাল মায়ার বাড়িতে খান। বাকি পনের দিন পালা করে অন্য ঘরগুলিতে খান। কিছু দিল হল তিনি বিয়ে করে এই গ্রামে স্থায়ীভাবে থাকবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় বিদেশি লোকটি হচ্ছে আজিজ মাস্টার। সে নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। প্রাইমারি স্কুল সরকারি সাহায্যে তিন বৎসর আগে শুরু হয়। উদ্দেশ্য বোধহয় একটিই–দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছানো। উদ্দেশ্য সফল হয় নি। শিক্ষকরা কেউ বেশি দিন থাকতে পারে না। খাতাপত্রে তিন জন শিক্ষক থাকার কথা। এখন আছে এক জন—আজিজ মাস্টার।
সব গ্রামের মতো এই গ্রামে এক জন পাগলও আছে। মতি মিয়ার শালা নিজাম। সে বেশির ভাগ সময়ই সুস্থ থাকে। শুধু দু-এক দিন মাথা গরম হয়ে যায়। তখন তার গায়ে কোনো কাপড় থাকে না। গ্রামের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে থাকে। দুপুরের রোদ খুব বেড়ে গেলে মধুবন জঙ্গলায় ঢুকে পড়ে।
চিত্রা বুড়ি রাতে একনাগাড়ে কখনো ঘুমায় না।ক্ষণে-ক্ষণে জেগে উঠে চেঁচায়, কেলা যায় গো? লোকটা কে? তাঁর ঘুমোবার জায়গাটা হচ্ছে সেনবাড়ির পাকা কালীমন্দিরের চাতাল। নীলু সেন তাঁকে থাকার জন্যে একটা ঘর দিয়েছিলেন। সেখানে নাকি তাঁর ঘুম হয় না।
গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে এটা প্রথম বুঝতে পারলেন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব। পাকা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি সূরা ইয়াসিন পড়ছিলেন। আজান দেবার আগে তিনি তিন বার সূরা ইয়াসিন পড়েন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় অবাক হয়ে পুরো দলটাকে দেখলেন। এরা স্কুলঘরের দিকে যাচ্ছে।একা বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হল, এই যে তিনি দেখলেন একদল মিলিটারি, এটা চোখের ভুল নয় তো? নান্দাইল রোডে মিলিটারি আসে নি, সোহাগীতে আসে নি—এখানে আসবে কেন? এখানে আছেটা কী? নেহায়েতই গণ্ডগ্রাম।
এবার এই গ্ৰামবাসীদের কী আছে কপালে সেটা তো গল্পের শেষে বোঝা যাবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভাবুন তো একটা গ্ৰাম, সহজ সরল মানুষগুলো আর তখনই মৃত্যুদূত হিসেবে আসা মিলিটারি। নেহায়েৎ কোনো সহজ বিষয় নয়। ১৯৭১ এর সময়। চারিদিকে শুধু অনিশ্চিত জীবন। এই গল্পটা সহজ আবার ভয়েরও। যেখানে জড়িয়ে আছে মৃত্যুভয়।
হুমায়ূন আহমেদের '১৯৭১" আহামরি কোনো গল্প নয়। লেখক এমনই এক গল্প বলতে চেয়েছেন কেবল যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উত্তাল পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে। একটি গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবন বদলে যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। হয়তো তাঁরা সরল, তারা গরীব। কিন্তু তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর মমতা আছে। তাই তাঁদের ছায়ায় গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে মুক্তি বাহিনী। তাঁদের খুঁজতেই যেন গ্রামে পা পড়েছে হানাদার বাহিনীর। সাথে কিছু রাজাকার। পাক বাহিনী যেখানে পা দেয়, সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কপালে কী আছে সেসব সাধারন মানুষের?
হুমায়ূন আহমেদের লেখনী নিয়ে আলোচনা নতুন করে বলার কিছু নেই বোধহয় কারণ হুমায়ূন আহমেদের লেখার ধরন যেমন সাবলীল তেমনি বর্ণনাভঙ্গি দারুন। তিনি একটা বিষয়কে উপস্থাপন করতে পারতেন সুন্দর করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উত্তাল ঘটনা বর্ণিত এই বইয়ে, যেন চোখের সামনে ভেসে উঠবে সব চরিত্র একসাথে।
চরিত্রগুলো খুব সুন্দর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মেজরের মাঝে যেমন আছে নৃশংসতা তেমনি আবার বর্ণনা আছে ব্যক্তি মেজরের। যুদ্ধের সময় নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত এক ব্যক্তি। আবার মেজরের সহযোগী ওই ছেলেটা, সে কী মনে মনে স্বেচ্ছায় মেজরের সঙ্গী হয়েছে? কোথাও কী তাঁর মধ্যে দেশের চিন্তা আছে? চোখের সামনে অন্যায় কীভাবে সহ্য হয়েছে তাঁর?
শেষটা টিপিকাল হুমায়ূন আহমেদের অন্য সব বইয়ের মতো। কী ঘটেছিল শেষটা পাঠক নিজের মতো নাহয় ভেবে নিতে পারে। কিন্তু এই গল্পটার রেশ থেকে যাবে মনে। কারণ যুদ্ধকালীন সাধারণ মানুষের মনোভাব হুমায়ূন আহমেদ এত সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন, তাঁর লেখনীর সার্থকতা এখানেই। তাই শেষে ভালো কিছু বরং ভাববো পাঠকেরা আমরা। শেষ কখনো দুঃখের হতে নেই তাহলে বইয়ের পাতায় যেন দুঃখ জমে থাকবে।
" সব কটা জানালা, খুলে দাও না আমি গাইবো, গাইবো বিজয়েরই গান ওরা আসবে, চুপি চুপি যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ"
মধুবন বাজার থেকে পুবদিকে সাত আট মাইল গেলে একটা জঙ্গল পাওয়া যায়। যার নাম স্থানীয়রা মধুবনের জঙ্গলা মাঠ দিয়েছিল। এই জঙ্গলা মাঠের ঠিক পেছনেই ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। নীলগঞ্জ। গুটিকয়েক মানুষ অত্যন্ত সুখে শান্তিতেই সেখানে বাস করছিল। সেই গ্রামের মানুষ এতটাই নিরক্ষর ছিল যে মসজিদের ইমাম সাহেবকেও তারা সেই কুমিল্লা থেকে নিয়ে এসেছিল। গ্রামে ছিল একটা মাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল। সেখানেও পড়ানোর মতো ছিল মাত্র একজন শিক্ষক। অবশ্য এসব নিয়ে গ্রামবাসীদের কোনো চিন্তাও ছিল না। তারা জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষদের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠত এবং সারাদিন কাজ করে গভীর নিদ্রায় রাত্রি পার করে দিত।
এই গ্রামে যে কখনো কোনো কৃত্রিম বিপদ আসবে, সেটা যেন ছিল কল্পনারও বাইরে। এই এতো সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কে এখানে আসবে ভেজাল লাগাতে? অন্যান্য স্বাভাবিক দিনগুলোর মতোই সেই দিনটাও শুরু হলো। যেদিন পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর গোটা পঞ্চাশেক লোক নীলগঞ্জ স্কুলে আশ্রয় নিল। ব্যাপারটা সর্বপ্রথম মসজিদের সিঁড়িতে বসে ইমাম সাহেব লক্ষ্য করেছিলেন। এরপরই শুরু হলো তাদের কার্যক্রম। প্রথমে ইমাম সাহেব, তারপর নীলগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার আজিজ সাহেব। কমান্ডার এজাজ আহমেদ তাদের দুজনকে অহেতুক এমন প্রশ্ন করলেন যা সম্বন্ধে তারা অবগত নয়। ফলাফল যা হবার তাই হলো, দুজনের উপরেই করা হলো অকথ্য নির্যাতন।
এখান থেকেই শুরু। এভাবেই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী একটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রামে এসে গেঁড়ে বসল। শুরু হলো একপাক্ষিক যুদ্ধ। আর আস্তে আস্তে নীলগঞ্জ গ্রামের নিরক্ষর, ঝুটঝামেলা না বোঝা মানুষেরাও পরিবর্তন হতে লাগল। হয়তো এর ফলাফল গিয়ে দাঁড়াবে ভয়ংকর কোনো পরিণতিতে...
◾ পাঠপ্রতিক্রিয়া : “১৯৭১” কোনো মুক্তিযুদ্ধের গল্প নয়। বরং একটা একপাক্ষিক যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করার গল্প। হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইয়ের মতো এই বইয়ের বর্ণনা ও শব্দপ্রয়োগও সাবলীল। তবে উল্লেখ করার মতো বেশ অনেক বিষয় এই বইয়ে আছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সকল মানুষই যে নিজ ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, এমন না। অনেকেই অনেক রকম কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কেউ হয়তো আপনজনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে, কেউ অপারগ হয়ে কিংবা হয়তো অন্য কোনো কারণে। একইরকমভাবে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীরও কিছু মানুষ ছিলেন যারা ব্যক্তি হিসেবে ভালো ছিলেন। কিন্তু কাঠামোগতভাবে যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর উদাহরণ হিসেবে মেজর এজাজ আহমেদের তার সহচারী রফিককে বলা কথাটি উল্লেখ করা যায়— “রফিক, আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। সারভাইভালের প্রশ্ন। এই সময়ে অন্যায় কিছু হবেই। উল্টোটা যদি হতো— ধরো বাঙালি সৈন্য আমার গ্রামে ঠিক আমাদের মতো অবস্থায় আছে, তখন তারা কী করত?... যে অন্যায় আমরা করছি তারা কি সেগুলো করত না?”
যাইহোক, অত্যাচারী তো অত্যাচারীই। তাদেরকে তো আর নিষ্পাপ বলা যাচ্ছে না। নীলগঞ্জের মানুষেরা যখন স্বাভাবিক ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করছিল তখন পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর সেখানে আগমণ হলো। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর তারা অকারণ নিপীড়ন চালালো। এটাকেই বলছি একপাক্ষিক যুদ্ধ। যেখানে তারা নীলগঞ্জের মানুষের উপর এমন উৎপীড়ন চালাচ্ছিল অথচ সাধারণ মানুষরা তাদের মোকাবিলা করবে কিভাবে, সেটাও জানত না। ফলস্বরূপ আস্তে আস্তে গ্রামের মানুষের মানসিক পরিবর্তন চলে আসল। নির্দিষ্ট একটা সীমা পার হলে মানুষের মনে আর ভয় থাকে না। যার সবকিছু হারিয়েই গিয়েছে তার আবার কিসের ভয়? তখন সফদরউল্লাহর মতো মানুষও দা হাতে বেরিয়ে পড়ে। বদলা নিতে। আর এভাবেই একটা মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়।
চরিত্রগুলো নিয়ে বলতে গেলেও লেখা বৃহৎ হয়ে যাবে। আমি যতদূর জানি, হুমায়ূন আহমেদের গল্পে চরিত্রদের নিয়ে তার কাজ পাঠক ভালোই জানেন। আমাকে আর আলাদা করে বলতে হবে না। উপন্যাসটা পড়ার সময় অন্যান্য সাধারণ উপন্যাসের মতোই মনে হবে। কিন্তু নীলগঞ্জ গ্রামের মানুষের জনজীবনের এমন পরিবর্তনও কিন্তু স্বাভাবিক নয়। একাত্তরে আমরা অনেকেই শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলাম ঠিক নীলগঞ্জের মানুষের মতো। যাদের দিনদুনিয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কিন্তু আমরা চাইলেই তো হবে না!...
পরিশেষে, “১৯৭১” কোনো মুক্তিযুদ্ধের গল্প নয়। একদল নিরীহ মানুষের উপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার গল্প। একদল সাধারণ বাঙালির জীবন আতঙ্কগ্রস্ত করার গল্প।
◾ বই : ১৯৭১ ◾ লেখক : হুমায়ূন আহমেদ ◾ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮০
১৯৭১ এর মে মাস, বাংলাদেশের নীলগঞ্জ গ্রামে হঠাৎ করে মিলিটারির একটি দল প্রবেশ করে। এই দলের অধিনায়ক হলেন মেজর এজাজ আহমেদ, যিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর, নির্দয়, নৃশংস একটি মানুষ। তার আদেশে নীলগঞ্জ গ্রামের এক বাসিন্দা আজিজকে তার সামনে নিয়ে আসা হয়।
নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার আজিজুর রহমান মল্লিক বা আজিজ। হঠাৎ একদিন ভোরবেলায় তার কাছে খবর আসে স্কুলে মিলিটারি ঢুকেছে এবং তাকে ডাকছে। বেলা সাতটা নাগাদ আজিজ মাস্টার সহ আরও পাঁচজন স্কুলের সামনে গেলে, মিলিটারি দলের মেজরের সাথে থাকা রফিক নামক ছেলেটি আজিজকে স্কুলের ভেতরে ঢুকতে বলে বাকি সবাইকে চলে যেতে বলে। ভেতরে প্রবেশ করার পর থেকেই মেজর আহমেদ তাকে একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকে, ফলে একসময় সে ভয়ে ওখানেই প্রস্রাব করে ফেলে।
এদিকে আজিজ মাস্টারের সাথে আসা বাকি পাঁচজনকে চলে যেতে বললেও তারা স্কুল থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মাস্টার না আসায় তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। কী হলো আজিজ মাস্টারের? মিলিটারিরা তাকে মেরে ফেললো না তো?
অন্যদিকে মিলিটারিরা গ্রামে হঠাৎ গুলি চালোনো শুরু করে। ভয়ে দিনের বেলাতেও গ্রামের মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোতে সাহস পায় না। কিন্তু কাকে, কী কারণে গুলিবিদ্ধ করলো তারা?
১৯৭১, এই বইটিতে তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের মানব সমাজের উপর কী পরিমান অত্যাচার হয়েছিল তার চিত্র ফুটে ওঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু-একটা লেখা এর আগেও পড়েছি, কিন্তু তবুও যতবারই নতুন কিছু লেখা পড়ি এই বিষয় নিয়ে ততবারই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
পাক মিলিটারিদের রাগ ছিল নাকি কেবল হিন্দুদের উপর, সত্যিই কি তাই? মুসলমানরা নিজেদের মনকে সান্তনা দিত এই ভেবে, যে পাক মিলিটারিরা তাদের মারবেনা কারন তারাও মুসলিম। ওরা শুধু হিন্দুদের ক্ষতি করবে। কিন্তু অত্যাচারের সময় কি শুধু হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছিল, মুসলমানরা হয়নি? তাদের বর্বরতার হাত থেকে কি কেউই রেহাই পেয়েছিল?
এই বই পড়ে আবারও আমি স্তব্ধ হলাম। ছোটোবেলা থেকেই দাদু-দিদার মুখে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অত্যাচারের অনেক কাহিনী। দাদুর এক পরিচিতকে যেভাবে পাক হানাদাররা অত্যাচার করে হত্যা করেছিল, সত্যি ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে যখনই নতুন কিছু পড়ি না কেন, প্রতিবারই একইরকম ভাবে স্তব্ধ হই, ভবিষ্যতেও কিছু পড়লে এইভাবেই স্তব্ধ হবো। এই উপন্যাস পাঠ করে কোনোভাবেই মনে তৃপ্তি আসেনা, কারণ এখানে আছে অসংখ্য মানুষের কান্না, হাহাকার। তাই এই উপন্যাস পাঠ করে শোকাহতই হতে হয়।
তবে কিছু প্রশ্ন থেকে গেল, যেমন~ বদির এবং সফদরউল্লাহ-এর মেয়ের কী হলো এগুলো জানা গেল না। কিন্তু যেই বিষয়টি ভালো লাগলো তা হলো মৃত্যু ভয়ে অপমানিত হওয়ার পরও, মানুষ নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করতে রাজি নয়। ভালো লাগার বিষয় আরও আছে, তবে সেগুলো বললে স্পয়লার হয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে স্বল্প পরিসরের মধ্যে উপন্যাসটি ভালো লেগেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি সম্পূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে। শক্তিশালী লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখা 'শঙ্খনীল কারাগার' পড়েই বুঝেছিলাম তিনি সাধারণ লেখাকে কীভাবে অসাধারণ করে তোলেন। ঝরঝরে, সাবলীল লেখনশৈলীতে তাঁর লেখা হয়ে ওঠে অভিনব। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কাহিনী সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে বইটি। আশা করি ভালো লাগবে। পাঠে থাকুন।
অজপাড়াগাঁ নীলগঞ্জ গ্রামের পটভূমিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের খন্ডচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। ডায়লগ, ঘটনাপ্রবাহের মধ্যমে হানাদারদের নিষ্ঠুরতার চিত্র এঁকেছেন। রাজাকারদের নারী লিপ্সাও কিছুটা দেখিয়েছেন। কাহিনির একপর্যায়ে মনা কৈবর্ত ও তার ১১ বছরের ভাইকে গুলি করে হত্যা করার দৃশ্য মাস্টার ও মসজিদের ইমামকে দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কাহিনির অন্যতম চরিত্র রফিক, মিলিটারি প্রধানের কাছে জিজ্ঞাসা করে, "কেনো তাদের নিয়ে আসা হলো?" মিলিটারি প্রধান শুধু বললেন, ভয় জন্মাবার জন্য,যাতে মুক্তিবাহিনীর কথা জানতে পারে। ফায়ার স্কোয়াডে যখন মনার ভাই বলে আমার খুব ভয় হচ্ছে দাদা! উত্তরে মনা বলে, ভয় পাসনে। আমাকে জড়িয়ে ধর শক্ত করে। আর তারপরেও ঝাঁঝরা হয়ে যায় দুজনের শরীর। এই দৃশ্য ভয়ংকর। ঝড়ে চাল উড়ে গেছে ঘরের। গাঁয়ে মিলিটারির আতঙ্ক। মিলিটারি মানুষ মারছে। অন্ধ বৃদ্ধ মীর আলী খুনখুন করে ভাতের জন্য কাঁদে। বদিউজ্জামান না ফেরা পর্যন্ত তার স্ত্রী ভাত চড়াবে না। তাই বলে মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণাতো চলে যায়নি। এই জায়গাটা..... ডিস্টার্বিং প্লট। কতোকিছু তুলে ধরেছেন অল্প কয়েক পাতায়। তবে খুবই সংক্ষিপ্ত। বড় গল্পের মতোই মনে হয়েছে। আরেকটু বড় হতে পারতো,আরও বিস্তারিত বলতে পারতেন লেখক।