রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের জন্ম ১৯৮৭ সালে কলকাতায়। সাত বছর বয়েসে যৌথপরিবার থেকে আলাদা হয়ে বাবামায়ের সঙ্গে মফস্বল শহর বারাসাতে চলে আসা। বাবা-মা সরকারী কর্মচারি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন বারাসাত মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। কবিতা লেখার শুরু ক্লাস এইট থেকে, প্রথম কবিতার বই সতেরো বছর বয়েসে। এঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন শিবপুর বিই কলেজ থেকে, পরবর্তীতে আই আই টি কানপুরে। পিএইচডি নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। গবেষণার বিষয় জলসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থানে অধ্যাপনা করছেন। প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সঙ্গে পাঁচ; একটি বাদে সব কবিতাবই স্বউদ্যোগে প্রকাশিত। গল্প-উপন্যাসের বই এযাবত আটটি; তিন প্রকাশক সৃষ্টিসুখ, বৈভাষিক এবং একতারা। গোয়েন্দা কানাইচরণ চরিত্রটির স্রষ্টা। কানাইচরণের উপন্যাসিকা 'চড়াই হত্যা রহস্য' অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ওয়েবসিরিজ 'ব্যাধ'। সম্প্রতি কয়েকটি বইয়ের ইংরিজি অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।
গোয়েন্দা বলতে আমাদের মানসচক্ষে যে ক্ষুরধার, স্থিতধী মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে কানাইচরণ ঠিক তেমন নন।তাকে শার্লক হোমস, ফেলুদাগোত্রীয় ভাবাই যায় না। অতি জটিল রহস্যের সমাধান তিনি তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অল্প সময়েই করে ফেলতে পারেন না। লেখকের ভাষ্যমতে, তিনি হচ্ছেন ক্লাসের সেই ভালো ছেলেটা যে প্রতিদিন পড়ে পাশ করেছে। কানাইচরণ পুরোপুরি ছা-পোষা ব্যক্তি। সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক বাঙালির সব দোষই তার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বহাল। তাহলে এই গোয়েন্দা সিরিজের বিশেষত্ব কী?
একটা রহস্যের সমাধান করা দীর্ঘমেয়াদী, ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। গোয়েন্দা গল্পে আমরা যে প্রক্রিয়ায় রহস্য সমাধান হতে দেখি বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি সময় ও শ্রম দিতে হয় গোয়েন্দাদের। তারা কল্পলোকের নায়ক নন, তাদেরও কার্য উদ্ধার করতে হাড়ভাঙা খাটুনি দিতে হয়। ছোট ছোট ক্লু ধরে ধরে, দিনের পর দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, একটা সূত্রের সাথে আরেকটা সূত্র জোড়া মিলিয়ে কানাইচরণ যেভাবে রহস্য সমাধানে ব্রতী হন তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।এতে বিস্ময়কর কিছু নেই তবে আছে বাস্তবসম্মত, নির্ভেজাল গোয়েন্দা গল্পের অনুভব। কানাইচরণের শ্রমসাধ্য ও কষ্টসাধ্য এ যাত্রা সফল হলে তার মতো আমরাও বিপুল আনন্দ বোধ করি। শুধু শেষটা নয়, পুরো যাত্রাপথটাই এক্ষেত্রে স্মরণীয়। কালাপানির দিশা ও পাইস হোটেলে হত্যা গল্প দুটো ঠিক সেভাবে জমজমাট না হলেও "চড়াই হত্যা রহস্য" অসসাধারণ একটা নভেলা। এই নভেলার কল্যাণেই কানাইচরণ প্রিয় হয়েছেন এবং প্রিয় থাকবেন।
কলকাতা নুয়ার ব্যাপারে প্রথম জানতে পারি স্নিগ্ধ রহমানের কল্যাণে। স্নিগ্ধ রহমান এককালে ফিল্ম নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করতেন। বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় ফিল্ম লিখিয়েদের কোন তালিকা করা হলে আমার মনে হয় স্নিগ্ধ রহমানের নাম সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকবে। এককালে মুখ ও মুখোশ অনলাইন সিনে ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি, ছিলেন ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপ সিনেমাখোরদের আড্ডার অন্যতম এডমিন। মুখ ও মুখোশে এক সময় আমিও লিখেছি। রুশো ভাই, সুদীপ দা’রাও ছিলেন তখন। সিনেমা নিয়ে প্রচুর আড্ডা হতো, আলাপ-আলোচনা হতো। স্নিগ্ধ রহমান পাঁড় ডি নিরো ভক্ত, আমি আল পাচিনোর। কে সেরা, এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এককালে। মুখ ও মুখোশের কার্যক্রম দীর্ঘদিন হলো বন্ধ, সিনেমাখোরদের আড্ডা গ্রুপটাও। সবাই প্রফেশনাল লাইফে ঢুকে প্রচন্ড ব্যস্ত। আড্ডা-টাড্ডা সেভাবে আর হয়ে ওঠে না। স্নিগ্ধ রহমানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। তাকে এখন স্রেফ ইনস্টাগ্রামে পাওয়া যায়। সেখানেই আলাপ হয় টুকটাক। উনার মাধ্যমেই জানতে পারি ব্যাধ নামের একটা ওয়েব সিরিজের কথা, যা কলকাতা নুয়ার একটা গল্প অবলম্বনে নির্মিত। কলকাতা নুয়া অর্ডার দিয়ে কিনে ফেলি। লেখক নতুন। আগে নাম শুনিনি। তার গোয়েন্দাপ্রবরটির নামও অজানা ছিল। স্নিগ্ধ রহমান ব্যতীত আর কারো কাছে বইয়ের নাম শুনিনি। গুডরিডসে দেখলাম কিছু রিভিউ আছে। ওগুলো থেকে একটা আন্দাজ নেয়ার চেষ্টা করি। তারপর বই হাতে আসলে পড়া শুরু করি। কলকাতা নুয়া মূলত গোয়েন্দা কানাইচরণের কাহিনী। কানাইচরণ লালবাজারের কর্মকর্তা, পদবীতে সিনিয়র ইন্সপেক্টর। মাথায় কোঁকড়ানো চুল, সাথে ঝোঁপালো গোঁফ। তার সঙ্গী জুনিয়র ইন্সপেক্টর সৌভিক আর রেকর্ডস সেকশানের পৃথুলা দিদিমণি। দিদিমণির প্রতি তার কিঞ্চিৎ ‘ইয়ে’ আছে। এই ‘ইয়ে’টা কী তা অবশ্য পুরোপুরি পরিষ্কার না। ভালোবাসা? আকর্ষণ? নাকি দুটোই? তো যাই হোক, অফিস শেষে এই তিনমূর্তি সেসিল বারে গিয়ে তরল পানীয় গিলে, আড্ডা দেয়। কানাইচরণ তার কেসের স্মৃতি রোমন্থন করেন। বাকি দু’জন শুনেন, টুকটাক প্রশ্ন করেন। আর এভাবেই এগিয়েছে কলকাতা নুয়ার কাহিনী। কলকাতা নুয়ায় মোট তিনটি গল্প। ১. কালাপানির দিশা, ২. পাইস হোটেলে হত্যা ও ৩. চড়াই হত্যা রহস্য। শেষোক্ত গল্পটিকে অবশ্য গল্প না বলে নভেলা বলা যায়। যদ্দুর জানি, এই চড়াই হত্যা রহস্য নিয়েই ব্যাধ নির্মিত। যদিও ব্যাধ এখনো দেখা হয়নি আমার। যে কোন বইয়ের, তা রহস্যরোমাঞ্চ হোক কিংবা কাঠখোট্টা প্রবন্ধ, লেখনী যদি যুৎসই না হয়, লেখায় যদি জড়তা থাকে তাহলে আমি পড়তে পারি না। কলকাতা নুয়ার লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক ওস্তাদ লিখিয়ে। তার লেখনী দুর্দার্ন্ত। নেশাধরানো। মাখনের মত মসৃণ। লেখায় খুব সূক্ষ হিউমার আছে ভদ্রলোকের। পড়ে সাংঘাতিক আরাম। কলকাতা নুয়া পড়ে একটা নতুন শব্দও শিখলাম। খোঁচড়। অন্যান্য লেখকরা খোঁচড়কে হয়তোবা সোর্স বলে কাজ চালিয়ে নিতো, কিন্তু রাজর্ষি দাশ ভৌমিক বেশ ইন্টারেস্টিং একটা নাম বেছে নিয়েছেন। গোয়েন্দা কানাইচরণের অভিযান শুরু হয়েছে কালাপানির দিশা নামের গল্প দিয়ে। কানাইচরণ বড়কর্তাদের বিরাগভাজন হয়েছেন কোন এক কারণে। তাকে ক্লোজড করা হয়েছে। কোন কেস-ফাইল তাকে দেয়া হচ্ছে না। স্রেফ নামকা ওয়াস্তে অফিসে আসছেন, যাচ্ছেন, বেতন নিচ্ছেন। তার বর্তমান কাজ পুরনো কেস ফাইল ঘাঁটা। এরকম কেস ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে রেকর্ডস সেকশনের দিদিমণি, যার ব্যাপারে কানাইচরণের কিঞ্চিৎ ‘ইয়ে’ আছে, তার হাতে একটা আনসলভড মিস্ট্রির কেস ধরিয়ে দেয়। ব্রিটিশ আমলে বঙ্গোপসাগর থেকে একটা আস্ত জাহাজ হারিয়ে যায়। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ এই হারানো জাহাজের কোন কুল কিনারা করতে পারেনি। কাহিনি ওই হারানো জাহাজ নিয়েই। কেসের ভেতরে ঢুকতে অনেক কেচ্ছা বেরিয়ে আসে। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে সমাধানো পৌছান গোয়েন্দা কানাইচরণ। ততক্ষণে পাঠকদের বেশ কিছু অজানা বিষয় জানা হয়ে গেছে। কলকাতা নুয়ার এটা একটা বড় শক্তি। গল্পগুলো অভিনব, বৈচিত্র্যময়। সচরাচর গোয়েন্দা কাহিনিতে যে ধরণের গল্প পড়ে আমরা অভ্যস্ত, তা থেকে কলকাতা নুয়া আলাদা। দ্বিতীয় গল্প পাইস হোটেলে হত্যাও ব্যতিক্রমধর্মী। পাইস হোটেল নামটা শুনে আমাকে গুগল করতে হয়েছিল। নামটা আমার জন্য নতুন। নেট ঘেঁটে বুঝলাম পাইস হোটেল মানে হলো ভাতের হোটেল। তো সেখানে খেতে গিয়ে দু’জন ছাত্র মারা যায়। ডাক পড়ে গোয়েন্দা কানাইচরণের। তাকে ক্লোজড করা হয়েছিল, কেসের জটিলতা অনুধাবন করে তাকে পুনরায় ওপেন করা হয়। কানাইচরণ জুনিয়র ইন্সপেক্টর সৌভিককে নিয়ে জটিল এই কেসের একটা গতি করতে নেমে পড়েন। তৃতীয় ও সর্বশেষ গল্পটি কলেবরে বড়। নাম চড়াই-হত্যা রহস্য। এটা কানাইচরণের পুরনো আমলের একটা কেস। কে বা কারা শয়ে শয়ে চড়ুই পাখি খুন করে যাচ্ছে। কারণ অজ্ঞাত। অনেকটা স্মৃতি রোমন্থনের আদলে বর্ণিত কেসটি। খুনীকে ধরার প্রক্রিয়াটি আমার কাছে দারুণ লেগেছে। ফাইলপত্তর ঘেঁটে, ম্যাগাজিন-পত্রিকা ঢুঁড়ে অবশেষে খুনীর দেখা মিলে। পাঠক ইতিমধ্যে এক পাক ঘুরে এসেছে বর্ধমান, বাঁকুড়া, মদনপুর থেকে। ঘুরে এসেছে সত্তর দশকের উত্তাল নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অন্যান্য অনেক থ্রিলার লিখিয়ের মত ইতিহাস গেলান না রাজর্ষি দাশ। ইতিহাস এখানে স্রেফ প্লটের খাতিরে আসে, পাঠকদের জ্ঞানদান করা এর উদ্দেশ্য না। আমি মোটামুটি ভক্ত বনে গেছি লেখক রাজর্ষি দাশের। কলকাতা নুয়া পড়ার সময়ই তার আরেকটা বই অর্ডার দিয়ে কিনেছি। অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার। এটা উপন্যাস। বলে রাখা ভালো, কলকাতা নুয়ার গল্প��ুলো কিন্তু একেবারেই গতিশীল না। আপনি যদি টানটান উত্তেজনার কোন রেসিং কার গতির থ্রিলার পড়তে চান তবে কলকাতা নুয়া আপনার জন্য না। এখানে তেমন ��োন টুইস্ট নেই, গল্প শেষে দুনিয়া উল্টে দেয়া কোন রিভিলেশন নেই। সহজ-স্বাভাবিক পুলিশ প্রসিডিউরাল বলা যায় কলকাতা নুয়ার গল্পগুলো। তবে এই গল্পগুলো এমন অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি ঘুপচির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, ইতিহাসের এমন কিছু বাঁকের সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয় যে আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাই। সবকিছু ভুলে আমরা পড়তে থাকি।
বাংলায় রহস্যকাহিনির কোনো অভাব নেই। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের কেন্দ্রে রেখে লেখা গোয়েন্দা গল্পও বাংলায় প্রচুর। কিন্তু খাঁটি পুলিশ, অর্থাৎ ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কার্যকলাপ আমরা ঠিক সেভাবে পড়ার সুযোগ পাই না— যেমনটা ইংরেজি ভাষায় হয়। সায়ন্তনী পূততুণ্ড'র 'অধিরাজ' সিরিজ আমরা গোগ্রাসে গিলি। কিন্তু আমরা এও মাথায় রাখি যে তাঁর এই আখ্যানমালা পরিকল্পিতভাবেই 'লার্জার দ্যান লাইফ।' আসলে আমরা ভাবি, সত্যিকারের পুলিশি তদন্ত হয়তো ডক্টর পঞ্চানন ঘোষালের ডকুমেন্টেড কেস-স্টাডির মতো হয়ে যাবে। আমরা প্রোসিডিওরালের বদলে নায়কের উপাখ্যান পড়তে চাই যে! নায়কের অতিনাটকীয় কার্যকলাপে চিহ্নিত এই প্রান্তরেই আবির্ভূত হয়েছেন রাজর্ষি দাস ভৌমিক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত রাজর্ষি'র নাম সুধী পাঠকের কাছে অপরিচিত নয়। এই বইয়ের 'আত্মপক্ষ' অংশে তিনি লিখেছেন— "গোয়েন্দা কাহিনির একটি বিশেষ সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য তার রহস্যের সৌন্দর্য।... এ তো শুধু বইয়ের কাটতি আর লেখকের খ্যাতির কথা ভেবে নয়!... বর্তমান কাহিনিকারও গোয়েন্দা-গল্পের সেই নিহিত সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট।" এই লাইনগুলো পড়তে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম৷ মনে পড়েছিল 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-য় ৪ঠা কার্তিক, ১৩৭৫ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ— "আমার মেজাজের সঙ্গে গুলি গোলা খাপ খায় না। তাছাড়া গোয়েন্দা কাহিনিকে আমি ইনটেলেকচ্যুয়াল লেভেলে রেখে দিতে চাই। ওগুলি নিছক গোয়েন্দা কাহিনি নয়।" গোয়েন্দা কানাইচরণের পৃথিবী সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের জগতের থেকে আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সেই পৃথিবীতে সাসপেনশন উঠে যাওয়ার আশায় একটা বড়ো ক্রাইমের জন্য মুখিয়ে থাকেন রহস্যভেদী। ক্লোজার থেকে বের করা হলে তিনি বাস-ট্রামের বদলে কোয়ালিসে চড়ার সুযোগ পেয়ে আবেগবিহ্বল হন। শিষ্যের ঘাড় ভেঙে নেভিকাট ও পাত্তর শেষ করতে যাঁর কোনো মনোবেদনা হয় না। হ্যাঁ, ইনিই হলেন গোয়েন্দা কানাইচরণ। তাঁকে দেখে ডিটেকটিভ বা পুলিশ অফিসার বলে মনে হওয়া কঠিন। কিন্তু কেস-ফাইল নেড়েচেড়ে হাফ বেলার মধ্যে সমাধানে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। এই কানাইচরণের তিনটি কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে 'কলকাতা নুয়া।'
নুয়া বা noir শব্দটি সাহিত্যে স্বীকৃত পদ। মূল ফরাসিতে এর আক্ষরিক অর্থ 'কালো'; তবে সিনেমা বা সাহিত্যে এটি একটি বিশেষ ঘরানা বোঝায়। সেই ধারায় মুখ্য হয় নেতিবাচক মানসিকতা, নীতি আর দুর্নীতির মাঝে ঝুলে থাকা ধূসর চরিত্রদের কার্যকলাপ, আর কিছুটা নিয়তি। সাহিত্যে যাদের আমরা এই ঘরানার পাস্ট মাস্টার বলে জানি (জিম থমসন, প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথ, মেগান অ্যাবট), তাঁদের থেকে কিন্তু একদম অন্য জিনিস লিখেছেন রাজর্ষি। কোনো-না-কোনোভাবে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে শিখতে ও শেখাতে থাকা এক সত্যান্বেষীকেই।
যে লেখাগুলো এই বইয়ে আছে, তারা হল: (১) কালাপানির দিশা: ক্লোজড অবস্থায় সময় কাটানোর জন্য লালবাজারের ক্রিমিনাল রেকর্ডস সেকশন থেকে ফাইল চেয়ে আর ঝটপট তার সমাধান করে মগজ চালু রেখেছেন কালীচরণ। রেজিস্ট্রার তাঁকে, একরকম চ্যালেঞ্জ হিসেবেই, একটা বহু পুরোনো কেসের ফাইল দিলেন। সাজাপ্রাপ্ত এক বন্দিকে নিয়ে আন্দামানের উদ্দেশে রওনা হওয়া একটা জাহাজ গন্তব্যে পৌছোয়নি। রেকর্ড বলছে, জাহাজটা মোহনার কাছে বালুচরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেছিল। সত্যি? আসলে কী হয়েছিল? গল্পটা দুর্দান্ত। জোসেফাইন টে'র 'দ্য ডটার অফ টাইম' যাঁরা পড়েছেন তাঁরা বুঝবেন, রহস্য ঘরানার অন্যতম সেরা লেখা তথা কোল্ড কেস-এর উদ্দেশে কী অনন্য একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন লেখক। আমার হিসেবে এটা পাঁচে পাঁচ পাবে। (২) পাইস হোটেলে হত্যা: নিতান্ত নিরীহ, কোনোরকম সাতে-পাঁচে না থাকা দু'জন মানুষ মারা গেল পাইস হোটেলে খেতে-খেতে। আর কোনো কাস্টমারের কিচ্ছু হয়নি। তারা দু'জন অতিরিক্ত কিচ্ছু নেয়নি। টেবিলে আর কেউ ছিল না। তাহলে? তদন্ত কিছুটা এগিয়ে যখন বন্ধ গলিতে ঢুকে পড়েছে, তখন আবার একটা খুন হল। তাতেও সব আগেরটার মতোই। কলকাতায় কি নতুন কোনো সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব হয়েছে? কীভাবে সে খুনগুলো করছে? এই গল্পটা পুরোপুরি মনের আলো-অন্ধকার দিয়ে গড়া। মোটিভ, মোডাস অপারেন্ডাই, সমাধান— তিনটেই এসেছে খুনের জায়গায় যারা গেছিল তাদের ও খুনির মন বুঝে। খুবই ভালো গল্প। তবে আমার কাছে এটি পাঁচে চার পাবে। (৩) চড়াই-হত্যা রহস্য: স্টোনম্যানের পর কি আর কোনো সিরিয়াল কিলার এসেছে কলকাতায়? শিষ্য শৌভিক ও রেকর্ডস সেকশনের দিদিমণিকে কানাইচরণ জানালেন, "হ্যাঁ, তবে কলকাতার কাছে কয়েকটা জেলায়। সে একেকবারে পঞ্চাশ থেকে সত্তরটা করে খুন করেছিল— তবে মানুষ নয়, চড়ুই।" প্রায় কুড়ি বছর পুরোনো সেই তদন্তের সবকথা এবার সামনে এল কানাইচরণের কথায়। আমার মতে এটাই এই বইয়ের সেরা লেখা। সিরিয়াল কিলারের প্রোফাইলিং, বাস্তব তদন্ত-প্রক্রিয়ার খুটিনাটি, পরিবেশ ও ফসল নিয়ে ভাবনা— সবকিছু নিখুঁতভাবে মিশিয়ে লেখা হয়েছে এই উপন্যাসোপম কাহিনিটি। নিয়মনিষ্ঠ পোলিস প্রসিডিওরাল হিসেবে এই কাহিনিটি বাংলায় অদ্বিতীয়। তাই এটিকে নির্দ্বিধায় পাঁচে পাঁচ-ই দিলাম আমি। ধুন্ধুমার অ্যাকশন আর খুনখারাপির বদলে যদি ক্রাইম ডিটেকশনের মাধ্যমে সত্যিকারের ক্যাট অ্যান্ড মাউজ গেমের স্বাদ পেতে চান, তাহলে এই বইটি আপনার অতি অবশ্যই পড়া উচিত৷ অন্তত আমার তাই ধারণা।
“কলকতা নুয়া”র তিনটি গল্প – কালাপানির দিশা, পাইস হোটেলে হত্যা, আর চড়াই-হত্যা রহস্য। কোন একটা অপরাধের রিপোর্ট হল – গোয়েন্দা বা পুলিশ আসল – ইনভেস্টিগেশন হল – কিছু সূত্র মিলে গেল – দেখা গেল অপরাধী নাকের ডগা দিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল – এরকম যে কাহিনী সচারাচর গোয়েন্দা গল্পে দেখে থাকি “কলকাতা নুয়া”র কোন কাহিনীই এই প্যাটার্নের সাথে মেলে না। তখনই একটা ধন্ধ লাগে। আর এই কারনেই এ গল্প গুলোকে আমরা বলছি “নুয়া”।
ইংরেজিতে “noir”, যার বাংলা অর্থ করেছে "নুয়া"। সাধারণ ক্রাইম জনরার সাথে এর তফাত আছে। ইন্টারনেটে পাওয়া একজনের সংজ্ঞাকে প্যারাফ্রেজ করছি – Noir has become a subgenre, often featuring a “regular guy” who gets dragged into the dark world through chance (wrong place, wrong time), a questionable moral choice (sounds like চড়াই-হত্যা রহস্য, huh?) or by a femme fatale. তার মানে কিন্তু এই না যে কোন ফিলসফিক্যাল কোয়েস্টের অবতারণা বা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব noir নিবে। কারন noir এর পৃথিবীতে “ভালো” আর “খারাপ” প্রিডিটারমাইন্ড। তুমি খারাপে পা দিয়েছ, তাতে করে noir পৃথিবীর সর্ব শক্তি তোমার বিরুদ্ধে এসে দাঁড়াবে – and things go in a downward spiral. আবার noir পৃথিবী অপরাধীর শাস্তির ও ব্যবস্থা রাখে, কিন্তু প্রশ্ন থাকে এই শাস্তির আদৌ তাকে “ভালো” বানাতে পারবে কি না।
লালবাজারের গোয়েন্দা-পুলিশ কানাইচরণ। “কালাপানির দিশা” গল্পে অফিসে বসেই পুরান ফাইল ঘেটে সমাধান করলেন ১৯১০-��৯১৩ সালের দিকে ঘটে যাওয়া একটা আনসলভ মিস্ট্রি –এক পলিটিক্যাল প্রিজনার নৃপেনকে কালাপানি পাড়ি দিয়ে আন্দামানে রেখে আসার সময় পুরো জাহাজ সুদ্ধো গায়েব হওয়ার কেস। এই গল্পটা তাও টিপিক্যাল গোয়েন্দা গল্পের আদলে ফেলা যায়। সূত্র জোগাড় – পাজল সল্ভিং – শেষে গিয়ে দ্যাট ইউরেকা মোমেন্ট। এটা তিনটার মধ্যে আমার সবচেয়ে কম প্রিয়, তার মানে এই না গল্পটা খারাপ, কিন্তু পরের দুটার কাছে হয়ত একটু দূর্বল লাগবে। “পাইস হোটেলে হত্যা” গল্পে দেখা যাচ্ছে ভাতের হোটেলে খেতে বসে রোডেন্টের বিষে মারা যাচ্ছে নিতান্ত নিরীহ, কারও সাথে-পাঁচে নেই এমন মানুষ। আর প্রতিক্ষেত্রেই ফরেনসিক রিপোর্টে মৃতদের পেট থেকে পাওয়া যাচ্ছে এমন খাবার যা তারা অর্ডারই করেনি। “চড়াই-হত্যা রহস্য” গল্পটা তো আরও সুন্দর। আমি রীতিমত ভৌতিক গল্পের ভয় পেয়েছি এটা পড়ার সময় – দক্ষিণ বাংলার দিকের কিছু গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে ঝাকে ঝাকে মুন্ডু কাটা চড়ুই পাখি। মানুষ না মরলেও এ গল্প ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলিংয়ের চেয়ে কোন অংশে কম রোমহর্ষক নয়।
কেন বললাম এই বইটা টিপিক্যাল গোয়েন্দা গল্পের বই না কারন এ গল্পগুলোয় আমরা প্রতি মূহুর্তে টান টান উত্তেজনার চেয়ে বরং পাব গোয়েন্দা ইনভেস্টিভেশনের বিশেষ একটা দিক – এক্ষেত্রে “কী” বা “কে” এর চেয়ে বরং “কেন” আর “কিভাবে” কে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন বলি – এ গল্পগুলোই গোয়েন্দা কানাইচরণ মোটামুটি সম্ভাব্য সব পথেই কম বেশি ট্রাই করেন। “পাইস হোটেলে হত্যা” গল্পে নিরীহ লোকদের মরতে দেখে একটা ধারনা আসবে যে হয়ত এই আপাত নিরীহ মানুষ গুলো কোন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছিল তাই তাদের মরতে হচ্ছে। আবার “চড়ুই-হত্যা রহস্য” গল্পে একটা ইনভেস্টিগেশনের ধারা যাবে কারা কারা পাড়ার লাইব্রেরি থেকে “The Fall of a Sparrow – Salim Ali” বা “চড়াই উতরাই” ইস্যু করেছে তাদের তালিকা তৈরী করতে (এখানে এসে ডেভিড ফিঞ্চারের se7en (1995) সিনেমাটার কথা মনে পড়ে না? :P )। যে দুটো ঘটনা বললাম, এদিকে খানিকটা এগিয়ে দেখা যায় এসব আসলে কোন কাজে আসে না। তবু এই ঘটনা গুলোর অবতারণা আমার মতে বেশ অনেকখানি রিয়েলিস্টিক করে তুলেছে গল্পগুলোকে। যেকোন অনুসন্ধানই আসলে একটা open ended question, সে ব্যাপারে বারবার একটা ওয়ার্নিং আমরা এই বইতে পাই।
“কলকাতা নুয়া” শেষ করলাম বেশ সময় নিয়ে। এই লেখকের অন্য বই গুলো পড়ার আগ্রহ পোষণ করছি।
পড়া হয়েছে বেশ কদিন। পুজোর চাপে গুডরিডসে আপডেট করতে দেরি হলো যা। তবে দু-একটা কথা না বললেই নয়। বাংলা ভাষায় প্রসিডিউরাল ঘরানায় পথিকৃৎ এই বইটির শক্তি তার বিশ্বাসযোগ্যতায়। পড়লে একটিবারের জন্যেও মনে হয় না, এই জগতটির রকমফের অবাস্তবে মোড়া। প্রতিটি সংলাপ যেন বাস্তবের মাটি হতে সেচে নেওয়া। চরিত্রদের মাঝে প্রতিটি বাক্যালাপ। পুলিশি পদ্ধতির জটিল একঘেয়েমি। আমলাতন্ত্রের সুবিধাবাদী চাল। কোথাও গিয়ে বলতে বাধ্য করে, হ্যা, এমনটাই তো হওয়ার কথা। এমনটাই তো বাস্তবে ঘটে।
সেই নিরিখে, গোয়েন্দা কানাইচরণ কোনো অসীম ক্ষমতাধারী সুপার স্লিউথ নন। তিনি আর পাঁচটা সাধারণ সরকারি কর্মচারীর মতন। অফিস করেন, ধীর লয়ে কেস ঘাটেন, সেসবের খাতিরে নানা দোরে ঘুরে বেড়ান, আবার দিনশেষে ডেকার্সে লাঞ্চ সারেন। এহেন বিবাহিত মানুষটির যে, মহিলাজনিত একটা 'ইয়ে' নেই, তা বললেও মিথ্যাচার হয়। মোটের ওপর, দোষগুণ সহিত কানাইচরণ একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ। ক্রাইম সলভিংটা তার সখের এক্তিয়ার নয়। ব্যাপারটা তিনি করে থাকেন, কারণ এটাই তার পেশা। এটা ছাড়া তার কোনো গতি নেই। এবং তাকে ছাড়া, ডিপার্টমেন্টের!
বইতে গল্প সংখ্যা তিনটি। তার মধ্যে, প্রথম দুটো গল্পে মূল রহস্য কিঞ্চিৎ দুর্বল। বিশেষত 'কালাপানির দিশা' গল্পের পরিণতি নেহাতই কষ্টকল্পিত। দ্বিতীয় গল্প, 'পাইস হোটেল হত্যারহস্য' কিছুটা বেটার। ধীর-স্থির, ত্বরাহীন রহস্য কাহিনী। লেখক অনেকটা সময় নিয়ে একটি ধূসর পৃথিবীর প্রতিকৃতি আঁকেন। ভালো লাগে। বাংলা রহস্য গপ্পো, পাল্প-ফিকশনের চটি জগতের বাইরে কদ্দুর অগ্রগমন করেছে, সেটারই জাজ্বল্যমান নিদর্শন। আফসোস, গল্পটির ফিনিশিং হৃদয়স্পর্শী হলেও, থ্রিলারের নিরিখে খুব একটা আহামরি নয়।
তবে, আপনাকে বইটি পড়ে যেতেই হবে ওই শেষ উপন্যাসটির জন্য। 'চড়াই হত্যা রহস্য' নামক এই অসাধারন গল্পটিকে, হালফিলের বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সার্থক রহস্যপোন্যাস বললে অত্যুক্তি হবে না। স্লো-বার্ন গোত্রীয়, একটি ভীষণ স্তরপূর্ন লেখা। যা আদতে একটি অভিনব সিরিয়াল কিলিংয়ের অসাধারন উপাখ্যান। ম্রিয়মাণ পরিণতি বাদে, গল্পটি নিঃস্বন্দেহে একটি মাইলফলক। নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়বার মতন একটি দারুন ক্রাইম কাহিনী। পাবেন বাস্তবের গোয়েন্দাগিরির আসল 'অথেন্টিক' স্বাদ। ক্লান্তিকর, একঘেঁয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া, বিউরোক্রেসির নির্লজ্জ ক্ষমতাপ্রদর্শন এবং সমাজের ক্লেদাক্ত পাঁক ঘাটার পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা!
কলকাতা নুয়া অনন্য। বাংলার মৌলিক রহস্য সাহিত্যে এরকম ডিটেইলড পুলিশ প্রোসিডিউরাল আগে পড়িনি। কনেলির হ্যারি বশের সাথে এই একটা ব্যাপারে মিল খুঁজে পেয়েছি। প্রচণ্ড রকমের ডিটেইলিং, তদন্তের ব্যাপারে। দু'টো গল্প আর একটা নভেলা আছে বইটায়। তিনটেরই প্লট/আইডিয়া সচরাচর রহস্য কাহিনী থেকে ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময়। গোয়েন্দা কানাইচরণও নিজ গুণে অনন্য। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি পাতায় পাতায় গতি, শেষে গিয়ে ভেল্কি লাগিয়ে দেয়া টুইস্টের আশায় থাকেন তবে হতাশ হতে হবে।
"কলকাতা নুয়া" বইটি আপনাকে নিয়ে যাবে লালবাজারের সিনিয়র ইন্সপেক্টর কানাইচরণ-এর জগতে—একজন সাধারণ চেহারার, কিন্তু অসাধারণ মেধার গোয়েন্দা, যিনি সরকারি চাকরির নিয়মকানুনের মধ্যেই রহস্য সমাধান করেন। তাঁর শুষ্ক হাস্যরস, মধ্যবিত্ত জীবনযাপন এবং সহকর্মী সৌভিক-দিদিমণির সাথে রসিকতা চরিত্রটিকে প্রাণবন্ত করে।
বইয়ে কানাইচরণের তিনটি কেস ফাইল স্থান পেয়েছে, প্রতিটিই স্বতন্ত্র ও চমকপ্রদ:
১. কালাপানির দিশা: ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ জাহাজ জর্জ দ্য স্যভিয়র রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়, যাত্রী ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী নৃপেন চট্টরাজ। একটি ঐতিহাসিক রহস্য নিয়ে গড়া গল্প, যা পাঠককে অতীতের দিকে নিয়ে যায়।
২.পাইস হোটেলে হত্যা: একটি হোটেলে ঘটে যাওয়া রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত, যেখানে বিষ প্রয়োগের পিছনের কারণ চমকপ্রদ।
৩.চড়াই-হত্যা রহস্য: সবচেয়ে আলাদা এবং চিন্তা-provoking গল্প, যেখানে পাখি হত্যার পিছনে লুকিয়ে আছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক রহস্য।
কলকাতা নুয়া: লালবাজারের বাতাসে যে কুয়াশা জড়ানো থাকে
"The darkest places in hell are reserved for those who maintain their neutrality in times of moral crisis." — Dante Alighieri
(১) ভূমিকা: noir-এর বাংলা পুনর্জন্ম: —যেখানে “little grey cells” নয়, উঠে আসে ঘাম, ধোঁয়া আর দীর্ঘসূত্রিতা।
যখন গোয়েন্দা কাহিনির বাজার ‘ডিজিটাল ডিটেকটিভ’, ‘হাই-অকটেন থ্রিল’ আর ‘অপূর্ব টুইস্ট’ নামক বেলুনে উড়ছে চাতকের মতো, তখন কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায়, মাটিতে দাঁড়িয়ে “রুটিন পুলিশি তদন্ত” নিয়ে গল্প বলেন—তাকে আমরা প্রথমে পাত্তাই দিই না। কারণ, আজকের গোয়েন্দা সাহিত্যে তদন্ত মানেই যেন টাইমলাইন-জাম্প, থ্রেড-রিভার্সাল, আর ক্লাইম্যাক্সে হেলিকপ্টার থামিয়ে খুনিকে পাঞ্চ করা।
কিন্তু একবার ��পনি যদি রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের কলকাতা নুয়া খুলে বসেন, আপনি বুঝবেন—এই বই কোনো থ্রিলার নয়। বরং এটি ধূসর আলোর নিচে লেখা এক ধীর, পদ্ধতিগত, একঘেয়ে মনে হলেও জ্বলে ওঠা তদন্তপদ্ধতির ম্যানুয়াল, যেখানে সাসপেন্স আসে তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা থেকে, উত্তেজনা আসে তথ্যের অভাবে নয়, তথ্যের আতিশয্যে।
এই বই যেন noir-এর বাংলা পুনর্জন্ম—not of thrill, but of truth। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঢাকা পুরনো ফ্যানের নিচে বসে থাক�� এক গুঁফো গোয়েন্দার ধৈর্যশীল ঘোরাফেরা। অচেনা অফিস ঘরের নোংরা ফাইলখানা, ঢেউখেলানো কাগজের পৃষ্ঠায় উঠে আসা একশো বছরের পুরনো কোনো প্রশ্ন—এই বইতে রহস্য এক অ্যাকশনে নয়, আসে অচেনা ক্লারিক্যাল একঘেয়েমির ভেতর থেকে।
এখানেই এসে পড়ে কানাইচরণ দাস।
না, তিনি কোনো হিরো নন। না কড়া ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, না অ্যাবস, না স্মার্টওয়াচ। তাঁর নেই বিদেশি ডিগ্রি, নেই শুঁটকি-মেজাজের সাইডকিক, নেই ক্লাসিক “reveal monologue”।
Poirot যেখানে murder dinner-এ খুনিকে “let us consider the psychology” দিয়ে ধরেন, কানাইচরণ সেখানে বলেন, “একটু বসুন। খাতাটা আনছি।” Poirot-এর “order and method”-এর বদলে কানাইচরণের আছে আরাম কুর্সিতে হেলান দিয়ে স্টেটমেন্ট পড়ে যাওয়ার ক্লান্তি, আর অব্যর্থ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে ফাটল খোঁজার চেষ্টা।
তবু দুজনেই সত্যান্বেষী। পার্থক্য এই যে, Poirot ঈশ্বরসদৃশ নির্মাতা; আর কানাইচরণ এক জেদি মিস্ত্রি।
Poirot-র রহস্যের সমাধানে থাকে এক নান্দনিক নির্মাণশৈলী, আর কানাইচরণের সমাধানে থাকে ঘাম, অভিজ্ঞতা, আর দিদিমণির ক্লিপবোর্ড।
কলকাতা নুয়া আসলে এক ব্রেক-আউট মোমেন্ট। noir শব্দটা যেমন তার মূল ফরাসিতে ‘কালো’ মানে দেয়, তেমনই এই বইয়ের noir মানে: মোহনবাগানের ক্লাবঘরে খুন, চড়ুইপাখি মরার প্রতিবেদন, আর পাইস হোটেলে বিষের গন্ধ।
এখানে গল্পের শেষ পাতা উল্টে যায়, কিন্তু তদন্ত শেষ হয় না।
এখানে গোয়েন্দা ক্লান্ত, অফিস-গাড়ির এসি খোলা থাকলে খুশি, জুনিয়রের টাকায় নেভিকাট খায়, আর খুনের দায়ে গ্রেফতার না করেও মিথ্যে চেহারার খোলস খুলে ফেলেন নিঃশব্দে।
এই বই পড়তে পড়তে মনে হয়— “গোয়েন্দা সাহিত্যের পুনর্জন্ম যদি হয়, তবে তা অ্যাকশন হিরো দিয়ে নয়, বরং অবসন্ন অথচ দৃষ্টি-ধারালো এক পুরনো মানুষ দিয়ে—যার হাতে সিগারেটের বদলে কেসফাইল।”
আর noir? noir এখানে শুধু ছায়া নয়—এখানে noir মানে হলো, কানাইচরণের মুখের রোদচশমা। যেটা খুললে সত্যিটা দেখা যায়, আর পড়লে সমাজটা।
(২) নুয়া নামকরণ: noir-এর বঙ্গীয় ছায়া
“There are different kinds of darkness,” Rhys said. I kept my eyes shut. “There is the darkness that frightens, the darkness that soothes, the darkness that is restful.” I pictured each. “There is the darkness of lovers, and the darkness of assassins. It becomes what the bearer wishes it to be, needs it to be. It is not wholly bad or good.” ― Sarah J. Maas, A Court of Mist and Fury
অন্ধকার শুধু আলোহীনতা নয়, অন্ধকার নিজেই এক ধরনের ভাষা।
‘নুয়া’ এসেছে ফরাসি শব্দ noir (উচ্চারণ: নুয়া) থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ—কালো, অন্ধকার, ছায়া। কিন্তু এই কালো কেবল কোনো রঙ নয়, এটি এক মনোভাব, এক দর্শন, এক নৈতিক দ্বিধার জমি।
১৯৪০-এর দশকে আমেরিকান ক্রাইম ফিল্মের এক উপধারা হিসেবে যখন ‘Film Noir’ জন্ম নেয়, তখন ‘noir’ মানে ছিল কেবল visual darkness নয়, বরং psychological darkness।
বহু সমালোচকের মতে, 'Film Noir' শব্দবন্ধটি প্রথম জনপ্রিয় করে তুলেছিল ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক Nino Frank, ১৯৪৬ সালে, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ঘোলাটে-ছবির ব্যতিক্রমী টোন এবং নৈতিক দোলাচল দেখে একে আলাদা শ্রেণিতে ফেলে দেন।
সেখানে গল্পের নায়ক আদৌ "নায়ক" নয়—সে হতাশ, ক্লান্ত, অনেক সময় পরাজিত, এমনকি ভুলও করে।
সে শার্লক নয়, মারপিট করে না, সুপারম্যানও নয়। তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল একরাশ প্রশ্ন, কিছু কাগজ, কিছু নীরব পর্যবেক্ষণ—আর অদ্ভুত এক সহানুভূতি।
এখানেই কানাইচরণ নামক চরিত্রটির সঙ্গে noir শব্দটির আত্মিক সাযুজ্য তৈরি হয়।
Noir মানে অন্ধকার, কিন্তু তা কুৎসিত নয়; বরং তা বাস্তব। যেখানে গল্প আসে ধোঁয়ায় ধরা সন্ধ্যাবেলায়, তদন্ত চলে ঝিম ধরা লালবাজারি অফিসে, আর সত্য আসে মদের গ্লাসের ফাঁকে গড়িয়ে পড়া সংলাপে।
নুয়া মানে তাই কেবল অন্ধকার নয়, তা এক ধরনের বাংলা-অনুবাদযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি— একখানা হোমিসাইড ফাইলে জড়িয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস, অথবা পাইস হোটেলের প্লেটের নিচে জমে থাকা বিষাদ।
যেমন Raymond Chandler বা Georges Simenon-এর নায়করা অন্ধকারে হাঁটে কারণ তারা "ভালো", তাই নয়—তারা হাঁটে কারণ তারা সত্যের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে চায়।
তেমনই, রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের কানাইচরণও হিরো নয়, অথচ পাঠকের নায়ক হয়ে ওঠেন।
তাঁর চেহারা-চুল-চশমা-চলাফেরা, সবকিছুই যেন noir-এর বাঙালি সংস্করণ। Poirot যেখানে “order and method”-এর মাধ্যমে সত্য আবিষ্কার করেন, কানাই সেখানে ভুল করেন, খোঁচড়দের ওপর ভরসা করেন, আবার রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে পুরোনো ফাইল পড়েন, যাতে মানুষটা বোঝা যায়, খুনটা নয়।
‘নুয়া’ শব্দটি তাই বাংলা সাহিত্যিক পরিসরে noir-এর সার্থক ছায়া— কিন্তু এই ছায়া হাড়ভাঙা রাত্রির নয়, বরং কষ্টসাধ্য ভোরের।
এই বইয়ের noir মানে বারুদ নয়, বরং বারান্দার বাতি। পুলিশ-অ্যাকশন নয়, বরং ফাইলের ভাঁজে লুকনো স্মৃতি।
"নুয়া" মানে noir, আর noir মানেই—ভালো মানুষদের ভুল করে ফেলা, আর তবু সঠিকটা করতে চাওয়ার ইচ্ছেটুকু বাঁচিয়ে রাখা।
(৩) চরিত্রচিত্রণ: লার্জার দ্যান লাইফ নয়, লার্জার দ্যান লিভড
"আমি গোয়েন্দা, কারণ আমি প্রতিদিন অনুসন্ধান করি। প্রতিদিন ভুল করি। প্রতিদিন আবার খুঁজি।"
কানাইচরণ দাস—না, তিনি কোনও ঝকঝকে হিরো নন। তাঁর পেশিতে ভাঁজ নেই, পকেটে নেই গ্যাজেট, পরিপাটি ব্যাকব্রাশ নয় চুল । তিনি সেই বাঙালি খুড়োমশাই, যিনি বিকেলে জ্যাকেট চাপিয়ে বের হন, এক হাতে পাউরুটি, আর অন্য হাতে ধোঁয়া ওঠা রহস্যের ছেঁড়া সুতো।
এই চরিত্রের আসল ম্যাজিক হল তার believability—তিনি ছায়াচরিত্র নন, তিনি চায়ের দোকানে বসে থাকা সেই অফিসার, যাকে আপনি দেখেও চিনতে পারবেন না।
তিনি অফিসে ঘুমান, ভুল করেন, ভুল স্বীকার করেন। সহকারী সৌভিকের কাছ থেকেও শেখেন—এমনকি তার ওপর ভরসা করেন। তাঁর গোয়েন্দাগিরিতে নেই একটিও মারপিটের দৃশ্য, নেই ব্র্যান্ডেড শার্পনেস, নেই প্যাথোলজিকাল অ্যারোগ্যান্স। তিনি জাস্ট মাথা খাটান।
তিনি সিগার খাওয়ার সময় রেকর্ডস সেকশনের ‘দিদিমণি’র দিকে প্রেমিক চোখে তাকান—না, অতিরঞ্জন নয়, নিছক মানবিকতা। তিনি সন্ধ্যায় যান সেসিল বারে, আবার মুগ্ধ হন কোয়ালিস গাড়িতে উঠতে পেরে। তিনি চাল-ডাল-বাজার নিয়ে কচকচ করেন গিন্নির সঙ্গে, আবার কেসের জন্য রাতভর জেগে থাকেন।
এখানেই ফেলুদা বা ব্যোমকেশের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য স্পষ্ট।
কিন্তু কানাইচরণ? তিনি আমাদের মতোই—একজন ক্লান্ত কর্মচারী, যার হাতে সত্য উঠে আসে ধীরে ধীরে, ধোঁয়া আর অনিচ্ছার মাঝখান দিয়ে।
আর যদি তুলনা টানতেই হয়, তাহলে বলা যায়— Poirot ‘method’ দিয়ে কাজ করেন, Holmes করেন ‘deduction’ দিয়ে, Feluda করেন ‘intuition’ দিয়ে, আর কানাইচরণ করেন ‘পচা চপের দোকান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞতা’ দিয়ে।
তার অস্ত্র কোনো সিগার, বা ছিপছিপে শরীর নয়—তার অস্ত্র তার শ্রম, তার শিরদাঁড়া, আর তার সংবেদনশীলতা।
তিনি আমাদের আজকের হিরো—not larger than life, but larger than lived experience।
(৪) তিনটি গল্প, এক একটি শহরনামা
(ক) কালাপানির দিশা: "আন্দামানের দিকে রওনা হওয়া জাহাজের সঙ্গে যদি হারিয়ে যায় ইতিহাস, তবে তা খুঁজে পাওয়া যায় কাদের কাছে? পুলিশের কাছে, না, সময়ের কাছে?"
১৯১১ সাল। আন্দামানের পথে রওনা হওয়া George the Savior নামের একটি জাহাজ হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের জলরাশিতে। না, কোনও সাইক্লোন নেই, জলদস্যু নেই, এমনকি ডুবে যাওয়ার কোনও ট্রেসও নেই। শুধু হারিয়ে যাওয়া... এক বিস্মৃতির মধ্যে।
এক শতাব্দী পর, লালবাজারের রেকর্ড সেকশনের ধুলো জমা আলমারি থেকে উঠে আসে সেই পুরনো কেসফাইল। আর সেই ফাইল খুলে বসেন কানাইচরণ দাস—একটি জাহাজ নয়, যেন হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের দিশা খুঁজতে।
এই গল্প নিছক তদন্তের খাতায় পড়ে না। এখানে রহস্যের চাবিকাঠি কোনও ডিজিটাল ফরেনসিক নয়, বরং যুক্তির শিরদাঁড়া। আবহাওয়াবিজ্ঞান, ব্রি��িশ সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কূটচাল, জাহাজ চলাচলের ইতিহাস, ভৌগোলিক সম্ভাবনা—সব মিলিয়ে এই গল্প হয়ে ওঠে এক ধরণের প্যারালাল হাইস্টোরিক্যাল ডিটেকশন।
গল্পের গতি ধীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ। এখানে ক্লু আসে মানচিত্র থেকে, পুরনো জাহাজ-রুটের রেফারেন্স থেকে, এমনকি বাতাসের গতিপথ থেকেও। শেষপর্যন্ত যেভাবে রহস্যের গিঁট খুলে যায়—তা যেন এক প্রকার “ইন্টেলেকচুয়াল আরোগ্য”।
এই কাহিনি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় ব্যোমকেশের ‘অচিন পাখি’ বা শার্লক হোমসের সেইসব কেস, যেখানে গোয়েন্দার শরীর যত না সক্রিয়, মস্তিষ্ক ততটাই ঘন-জটিল।
আর তাই, ‘কালাপানির দিশা’ হলো সেই ক্লাসিকাল গোয়েন্দাকাহিনী, যা বলে— "অন্ধকার খোঁজার জন্য আলো নয়, যুক্তির দরকার।"
(খ) পাইস হোটেলে হত্যা
"রুটি খেতে খেতে মৃত্যু? এই শহরে খাবার শুধু ক্ষুধা মেটায় না, মাঝে মাঝে সত্যিগুলোকে গিলে ফেলে।"
উত্তর কলকাতার এক পাইস হোটেল। দেওয়ালে অ্যালুমিনিয়ামের থালা, ডালে কম জল, আর ক্যাশ বাক্সের পাশে ময়লা তোয়ালে। এমন এক জায়গায়, একরাতে হঠাৎ করে দু'জন কলেজ পড়ুয়া খেতে খেতে টেবিলেই লুটিয়ে পড়ে।
পোস্টমর্টেমে মিলল—বিষক্রিয়া।
কিন্তু প্রশ্নটা দাঁড়াল—ওই দু’জন কি এমন খেল, যা অন্য কেউ খেল না?
একই রান্না, একই পরিবেশন, একই চামচ।
তবুও মৃত্যু কেন শুধু ওদেরই প্লেট চেনে?
এই কেসটা থেকে কানাইচরণের ‘ক্লোজড’ ছুটি শেষ হয়।
ডিপার্টমেন্ট তাকে চায়, কারণ খুন এখানে খেতে বসে আসে।
এখানে গোয়েন্দাগিরির চেয়ে রন্ধনপ্রণালির ফরেনসিক বেশি গুরুত্ব পায়।
কানাই এক এক করে জোগাড় করেন clues—নুনদানী, জলতেষ্টা, ফ্রি রিফিল, নীরব বাচ্চা।
আর আমরা বুঝি, একটা পাইস হোটেল আসলে একটা কেমিক্যাল ল্যাবও হতে পারে।
তবে, এ গল্পের শেষ একটু কুণ্ঠিত। একরকম 'আহা, এই তো!' বলার আগে গল্প সরে যায়। যেন লেখক পাঠকের গালে হালকা চিমটি কেটে বলেন, “সব প্রশ্নের উত্তর লেখকের কাজ না। কিছু সন্দেহ থেকে যাক—শহরটা যেমন, গল্পটাও তেমন।”
এই কাহিনিতে শার্লকিয় তীক্ষ্ণতা নেই, কিন্তু আছে কলকাতা স্টাইলে জট ছাড়ানোর সেই ক্লাসিক ধৈর্য। খিদে যেমন ফিরে ফিরে আসে প্রতিদিন, এই কাহিনিও বলে— “খাবার যতই সস্তা হোক, তার গল্প কখনো সস্তা হয় না।”
(গ) চড়াই-হত্যা রহস্য: একটি পাখির মৃত্যু, একটি শহরের আত্মকথা
"একটা চড়াই মরলে পৃথিবী থেমে থাকে না। কিন্তু শয়ে শয়ে চড়াই গলায় কাটার মতো মরে গেলে, কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘোরতর অসুস্থ।"
এই গল্প “কলকাতা নুয়া”-র হিরে, হেডলাইনার, হল অফ ফেম। শুধু একটা সিরিয়াল কেস নয়, এটা গল্পের ছদ্মবেশে লেখা এক মনোলিথিক এলিগি।
কানাইচরণ এখানে অতীতের এক কেস বলছেন—শুধু একটি না, শয়ে শয়ে চড়াই পাখিকে কেউ খুন করেছে ধারাবাহিকভাবে। না, কোনো নিছক রূপক নয়। এ কোনো “সিম্বলিক” স্টান্ট নয়। এটা রক্তমাখা বাস্তব—অতিলৌকিক না, অথিলৌকিক।
এই গল্পে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যেগুলো পাতার বাইরে এসে বুকের ওপরে বসে থাকে ঠিক চড়াইয়ের মতো—হালকা, কিন্তু দম বন্ধ করা।
কেন মারছে চড়াই পাখিকে?
কে সেই খুনি?
কীভাবে শহরতলির আবছা আলো আর নিঃসঙ্গ অন্ধকারে হারিয়ে যায় এতগুলো গলা?
কেন পুলিশ দেরি করে, কেন তদন্ত থমকে থাকে?
এ গল্পে কেসটা শুধুই তদন্ত নয়—এটা হল প্রায় তিন দশকের বাংলাদেশি-বাঙালি রাজনৈতিক শূন্যতার ম্যাপিং। লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এখানে শুধু একটা ডিটেক্টিভ কেস লেখেননি, একটা জনপদের সত্তার ওপরে ময়লা, দুঃখ, আর রক্তের প্রলেপ এঁকেছেন।
গল্পে চমৎকারভাবে এসেছে—
ক. লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ, যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা একটা চা-চক্রে নষ্ট হয়
খ. নকশাল আন্দোলনের পরের প্রজন্ম, যারা এখনও প্রাচীন শোকে পুড়ে
গ. শহরতলির হেমন্তবেলার নিস্তব্ধতা, যা শহরের বুকে লুকিয়ে থাকে হিংসার মত
"ব্যাধ" ওয়েব সিরিজ এই গল্পের ফ্লেভার ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু হাড়-মজ্জা অবধি পৌঁছতে পারেনি। সিরিজে চমক ছিল, কিন্তু গল্পে আছে চাপা কান্নার গন্ধ।
এখানে যে কানাইচরণকে দেখি, তিনি আর লালবাজারের সিগারেট ধরা ক্লার্ক নন। তিনি হয়ে উঠেছেন নীরব সাক্ষ্যদাতা, যিনি দেখেছেন, “যে সমাজ চড়াই মারতে পারে, সে সমাজ যেকোনোদিন মানুষের গলাও কাটতে পারে।”
এই গল্প পড়ে আপনি আর কোনো পাখির দিকে আগের মতো তাকাতে পারবেন না। আপনি বুঝবেন, সিরিয়াল কিলার গল্পেরও কাব্যিক ক্ষমতা থাকে, যদি সেটা লেখা হয় কানাইচরণের চোখ দিয়ে।
এই গল্প ক্লাসিক। এই গল্প সমসাময়িক। এই গল্প—রক্তমাখা পর্দার ওপারে চুপ করে বসে থাকা এক ‘কালো কবিতা’।
(৫) পুলিশি তদন্তের টেক্সচার: নখে জমে থাকা ময়লা, আর চোখে জমে থাকা রাতজাগা ক্লান্তি
এই বই পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়—আমরা এতদিন ভুলেই গেছিলাম, যে গোয়েন্দা মানেই হিরো হতে হবে না। তার ব্লেজারে চুম্বক থাকবে না, গলার আওয়াজে জোর থাকবে না, মুহুর্মুহু থ্রিল থাকবে না।
তিনি হতে পারেন একজন সরকারি অফিসার, যার ডেস্কে পুরোনো ফাইলের গন্ধ, টেবিলের নিচে পায়ের ওপর পা তুলে নেওয়া অভ্যেস, আর ভেতরে ভেতরে হাঁফ ধরা একটা মন।
কানাইচরণ ঠিক এমনই।
তিনি কোনোদিন থার্ড ডিগ্রি দেন না, কিন্তু প্রশ্ন করেন এভাবে, যেন উত্তরের চাপে জবানবন্দী ভেঙে পড়ে।
তিনি খোঁচড়দের তথ্য নিয়ে বসেন, তাদের ‘গুজব’কে পাতায় পরিণত করেন।
তাঁর তদন্ত, একেকটা দাগ-মাখা কফির কাপের মতো—টুকরো টুকরো অস্পষ্ট ছাপ, যেগুলো ধৈর্য ধরলেই একটা প্যাটার্নে পরিণত হয়।
এখানে পুলিশি তদন্ত মানে অ্যাকশন নয়।
না গাড়ি চেজ, না অ্যানালাইটিকাল স্ক্রিন, না ব্লাড-স্প্ল্যাটার অ্যাক্সেলারেশন থিওরি।
এখানে তদন্ত মানে—পথঘাটে ঘোরা, ট্রান্সক্রিপ্ট পড়া, বারবার সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখা, ক্লান্তি নিয়ে লালবাজার ফেরা।
রাজর্ষি দাশ ভৌমিক গোয়েন্দাগিরির glamour ফাটিয়ে ফেলে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করান কঠিন পরিশ্রমের এক পৃথিবীর সঙ্গে।
ছোট ছোট সংলাপ, নোটবুকে কাঁচা অক্ষর, ফোনকলের টুকরো তথ্য—এই সব কিছু মিলে গড়ে ওঠে "পুলিশি পদ্ধতির সাহিত্য"।
আপনি পড়ে ফেলেন—
**কীভাবে একজন থানা-ঘষা ইনস্পেক্টর অপরাধের মানচিত্রে পথ আঁকেন,
**কীভাবে রেকর্ডস সেকশনের মেয়েটা একটা পুরোনো ফাইল দিয়ে বলে ওঠেন, “দেখুন তো পারেন কিনা,”
**কীভাবে মাঠে-ঘাটে বারো ঘন্টা পরে ফিরে এসে কানাই বলেন, “আমার তো এখনও কিছু বোঝা হল না।”
(৬) ভাষা ও কাঠামো: তীক্ষ্ণ, কিন্তু প্রাঞ্জল—যেন ছেঁড়া সোয়েটারের পকেটে রাখা ব্লেড
রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের ভাষা প্রথমেই যা মনে করিয়ে দেয়, তা হলো—কোনও কেতাবি উত্তম পুরুষ নয়, বরং এক চা-স্টলের পাশে বসা, অভিজ্ঞ, ক্লান্ত কিন্তু পর্যবেক্ষণময় এক বয়ানকারী।
তিনি যখন লেখেন, তখন শব্দ যেন ভেজা হাওয়ার মতো ঘাড়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। তার প্রতিটি সংলাপে আছে "দিল্লি নয়, এই তো বউবাজার"—এরকম এক ইনফ্লেশনহীন বাস্তবতা।
ভাষা এখানে লজিকের বাহন, কাব্যের খোলস নয়। শহরের অন্ধ গলি, লালবাজারের ফাইলরুম, কিংবা রেকর্ড সেকশনের ‘দিদিমণি’র আড়াল—সেইসব প্রান্তিক অভিজ্ঞতাকে রাজর্ষি অনায়াসে তুলে আনেন নিজের সাবলীল বাক্যে।
তাঁর গদ্য মাঝেমাঝে থেমে যায়, যেন ভাবছে। আবার হঠাৎ শুরু হয়, যেন মনে পড়ে গেছে কোনো ক্লু। এই ছন্দহীনতা আসলে এক ধরণের স্টাইল—যেটা পাঠককে গতি দেয়, আবার থামতেও শেখায়।
আর সাসপেন্স?
এই বইয়ে "whodunit" শুধু একটা স্টার্টিং পয়েন্ট।
বাকি রহস্যগুলো চলতে থাকে—
**Why-dunit: খুনি মারল কেন?
**How-dunit: খুনটা কীভাবে ঘটল?
**What-broke-inside: খুনটা কাকে ভেঙে দিল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমরা পাতার পর পাতা উল্টাই। এবং তার জন্য রাজর্ষি আমাদের পাশে বসিয়ে রাখেন, গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন—লজিক, স্যাডনেস, আর এক চিলতে নস্টালজিয়া।
তাঁর কাঠামো সিনেমাটিক নয়, বরং ডকুমেন্টারি-ধর্মী। আবেগ আছে, কিন্তু ওভারড্রামা নেই। ঝলমলে শব্দ নেই, কিন্তু থাকে একরাশ স্তব্ধতা, যা কখনও খুনের মতই ঠাণ্ডা।
(৭) পাঠকের চোখে কানাইচরণ: সম্পর্কের গোয়েন্দা, আত্মীয়ের মতো স্নেহময়, প্রতিবেশীর মতো বিরক্তিকর
কানাইচরণ দাসকে পাঠক মনে রাখে, কারণ তিনি আমাদের মতো, এবং তাতেই তাঁর জাদু। তিনি চার্মিং নন, চার্মলেসও নন। বরং তিনি সেই গোয়েন্দা—যার চুলে তেল দেওয়া আছে, মুখে টক-মিষ্টি সংলাপ, এবং একধরনের অস্বস্তিকর আত্মিক আন্তরিকতা।
তিনি অফিস শেষে বার-এ যান, কারণ সেখানে কিছুক্ষণ "আমি" হয়ে থাকা যায়। তিনি বউকে একটু এড়িয়ে চলেন, কিন্তু ডাইনিং টেবিলে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে থাকা একটা দাম্পত্যবোধ লুকিয়ে রাখেন। তিনি অফিসে এক নারীর প্রতি দুর্বল—সেই রেকর্ডস সেকশনের দিদিমণি, যার দিকে চেয়ে চেয়ে অল্প একটু ভালো লাগা মিশে যায় একটা বাতিল ফাইলের মতো। তিনি জুনিয়রের ওপর খিটখিটে, আবার তার দক্ষতা দেখে চুপচাপ মুচকি হাসেন, মনে মনে ভাবেন, “এই ছেলেটা পারবে।”
এইসব মিলেই কানাইচরণ এক গোয়েন্দা নন, এক গোত্র।
পাঠকের কাছে তিনি কেবল রহস্যের সমাধানকারী নন, তিনি সম্পর্কের রহস্য অনুধাবন করেন। তিনি জানেন কোন খুন শিরদাঁড়া থেকে হয় না—হয় বুকের ফাঁকা জায়গা থেকে। তাঁর প্রতিটি মন্তব্য, প্রতিটি পর্যবেক্ষণ—একেকটা মাইক্রো-জাজমেন্ট, যেটা আমরা নিজেরাও করি, সকালে অটোতে বসে, রাতের ছাদে চেয়ে থেকে।
তাই কানাইচরণ চরিত্র নন, তিনি এক অল্টার-ইগো, এক মিরর ইমেজ, যে প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে ফাইল পড়ে, কিন্তু মনের গভীরে একটাই প্রশ্ন রাখে: “এই পৃথিবীটা এমন কেন?”
আর পাঠক, সেই প্রশ্ন শুনেই কাঁদে। কারণ আমরা সবাই কানাইচরণ। আমরা সবাই একটা রহস্যের ভিতরে বাস করছি—যার নাম জীবন।
ওফ! এমন চরিত্র বাংলা সাহিত্যে কমই আসে, আর যার আসে, সে চুপচাপ বারবেঞ্চে বসে থাকে। কানাইচরণ সেই ছায়ার গোয়েন্দা—investigator of silences।
(৮) উপসংহার: noir ও নুয়া, আলো ও ছায়ার দোলাচল
"When you stare long into the abyss, the abyss also stares into you." — Nietzsche
রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের কলকাতা নুয়া আদতে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সেই নিঃশব্দ অভ্যুত্থান, যেখানে বোমা ফাটে না—শুধু একটা পেনের টোকায় জেগে ওঠে মৃত কেসফাইল, আর তাদের থেকে জেগে ওঠে অপ্রকাশিত ইতিহাসের স্পন্দন।
এ বই পড়া মানে কেবল একটা রহস্য সলভ হওয়া দেখা নয়—এ বই পড়া মানে নিজের চেনা কলকাতা শহরটাকে নতুন চোখে দেখা, পলিস্পন্ধিত, কুয়াশাঘেরা গলির মধ্যে দিয়ে সত্যের ঠান্ডা নিঃশ্বাস টের পাওয়া। এটা এমন এক বই, যা গল্পের শেষে থামে না—বরং পাঠকের ভিতরে এক একটা কেসফাইল খোলার চাবি রেখে যায়।
রেটিং: ৪.৮৫/৫
পাঠ-প্রস্তাব: যারা Tinker Tailor Soldier Spy, Mindhunter, বা Slow Horses-এর মতো ধৈর্যসাধ্য, ইনটেলেকচুয়াল প্রোডিউরাল ডিটেকটিভ ফিকশন ভালোবাসেন—যেখানে অ্যাকশনের চেয়ে বিশ্লেষণ বড়ো, যেখানে চরিত্রের ক্লান্তি, রাষ্ট্রের নৈরাশ্য, আর তদন্তের ধাপে ধাপে জমা পড়া ধুলোই আসল প্লট—তাঁদের জন্য কলকাতা নুয়া একেবারে must-devour।
আরও বলি—
১) The Dry by Jane Harper: অস্ট্রেলিয়ার গহিনে যে তদন্ত চলে, সেটা কানাইচরণের ক্লান্তি ও ল্যান্ডস্কেপের মতোই ধুলোমাখা ও মন্থর—তবু চুম্বকের মতো টানে।
২) The Silence of the Rain by Luiz Alfredo Garcia-Roza: রিও ডি জেনেইরোর একান্ত নিজস্ব থমথমে নগরপটভূমিতে যে প্রোডিউরাল ডিটেকশন গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে কলকাতা নুয়ার টেক্সচারাল আত্মীয়তা অবাক করে।
৩) Laidlaw by William McIlvanney: স্কটিশ grim realism, নৈতিক জটিলতা, আর একটি ক্লান্ত কিন্তু অনুভবক্ষম গোয়েন্দা—বেশ খানিকটা কানাইচরণের মতোই।
৪) Simenon's Maigret series: তদন্ত এখানে উত্তেজনায় নয়, বরং মানবিক সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে, ঠিক যেমন কানাই কোনো থাপ্পড় নয়, বরং ছুঁয়ে দেখেন কেসের পালস।
Bottom line: কলকাতা নুয়া হলো Le Carré–র ঘরানার স্মোকি ইনটেলিজেন্সে ভেজানো একটা বাংলা পাটিসাপটা। যেখানে রস আছে, রাশনাল আছে, আর আছে সেই চেনা কলকাতা-ঘ্রাণ—ধুলো, ধোঁয়া, আর ডিটারজেন্ট মেশানো বারান্দা। পড়লে বুঝবে, কেন আমরা বলে ফেলি— "Bangla procedural is not a genre. It's a mood."
শেষ পঙ্ক্তি (সশব্দে বলুন চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে):
কানাইচরণের চোখে কলকাতা আর কোনও মেট্রো শহর নয়—
এ শহর এক অপরাধপত্রী,
যার প্রতিটি অন্ধকার গলিতে অগণিত অসমাপ্ত কেসফাইল ছড়িয়ে আছে।
কলকাতা noir বা নুয়া রাজর্ষি বাবুর পড়া প্রথম বই আমার। দুটি বড়ো গল্প আর একটি novella নিয়ে তৈরি বইটা slow burn থ্রিলার ভক্তদের অপূর্ব লাগবে। পুলিশ procedural থ্রিলার হিসেবে এ রাজ্যের পুলিশ ডিটেকটিভদের কর্মপদ্ধতি, ফরেনসিক পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা আর অত্যধিক কম ম্যান পাওয়ার এগুলো নিয়ে - সর্বোপরী সর্বত্র অসহযোগিতার ঘেরাটোপে লেখা গল্পগুলো আর গল্প নয় বরং সত্যি হয়ে ওঠে। এই শহর লন্ডন বা নিউইয়র্ক নয়, যেখানে সমস্ত কিছু সিস্টেমেটিক পথে হয়। তাই বোধহয় বেশি ভাল লেগেছে, সত্যিটা লেখার জন্য। গল্প হিসেবে পাইস হোটেল হত্যারহস্য বেশ চমকপ্রদ। সুন্দর detailing আর টুইস্ট এর জন্য। প্রথম গল্পে গোয়েন্দাদের কল্পনার উচ্চতা অনুভব করতে পারা যায়। হাতে অতি অল্প তথ্য থাকার জন্য গোয়েন্দারা কী পন্থা অবলম্বন করে সেটা জানার সুযোগ হল। তৃতীয় গল্পটি এই বইয়ের সবথেকে জটিল গল্প। Noir ধাঁচের বইয়ের বিশেষত্ব সবরকম মেনেও কানাইচরন বেশ sarcastic ও। সূক্ষ রসিকতার অনেক নিদর্শন বইয়ের পাতা জুড়ে। ফলে পড়তে মজা লাগে। তবে কয়েকটা বানান ভুল চোখে পড়ল। সেইসঙ্গে বারবার "বনে যাওয়া" নামক হিন্দি শব্দবন্ধটি দৃষ্টিকটু লাগল। বাংলায় এর যথার্থ বিকল্প আছে, সেটা ব্যবহৃত হলেই ভাল লাগতো। এটা ছাড়া বইয়ের ভাষা বেশ মনোমুগ্ধকর। সবশেষে বলা যায় বেশ অন্যরকম জিনিস পড়লাম বাংলায়, যেগুলো এতদিন ইংরাজিতে দেখে এসেছি।
অন্যসব গোয়েন্দা গল্পের মতোই এতে জটিল কেইস আছে, দৌড়ঝাপ আছে, গোয়েন্দার সহকারীও আছে। তবু কলকাতা নুয়াকে ব্যাতিক্রম করেছে গোয়েন্দা কানাইচরণ চরিত্র। সচরাচর গোয়েন্দা গল্পের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন গোয়েন্দা তিনি নন। তিনি অভিজ্ঞতা আর বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন। গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা আর কানাইচরণ কলকাতা নুয়াকে অনন্য গোয়েন্দা গল্পে পরিণত করেছে।
“The world is full of obvious things which nobody by any chance ever observes.” (একটি ডিটেক্টিভ বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া শুরু করলাম শার্লক হোমসের কোটেশন দিয়ে। কি প্রেডিক্টেবল কথাবার্তা!)
এ যেনো হাল্কা গরম গরম সিঙাড়ার সাথে পেঁয়াজ কামড়ে খাওয়া। কি তৃপ্তি! আচ্ছা ভেবে দেখেছেন, গাণিতিকভাবে খুব অসাধারণ মানুষেরাই কিন্তু আসলে সবচাইতে সাধারণ। সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য কি -- এই নিয়ম মেনে চলা, পৃথিবীর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করা, যেখানে যতটুকু করণিয় তা সম্পাদন করা, স্বাভাবিক আবেগ থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি... খেয়াল করে দেখেন, একজন অসাধারণ মানুষের বর্ণণাও কিন্তু এটাই। তো এই গল্পের লেখক ভাবলেন, একজন অসাধারণ গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করবেন। প্রচলিত জনপ্রিয় গোয়েন্দা গল্পের ছাঁচের বাইরে গিয়ে, থ্রিল, উত্তেজনা, অনুমান বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রহস্যের সৌন্দর্য্য রেখে একজন অসাধারণ নতুন গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করবেন। তো অনেক ভাবার পর দেখা গেল, গল্পের গোয়েন্দাচরিত্রটি শার্লক হোমসের মতো ক্ষুরধার বুদ্ধিহীন, মিস মার্পেলের মত অভিজ্ঞতাময় জীবনহীন, ফেলুদার জিনহীন, ফাদার ব্রাউনের মতো অনুমান ক্ষমতাহীন, এমনকি ব্যোমকেশ, কাকাবাবু কারো সাথেই মিল নাই এই গল্পের গোয়েন্দার। এ আবার কেমন গোয়েন্দা! এ গোয়েন্দার তাহলে স্পেশাল গুণটা কি? পরিচিত হচ্ছি, গোয়েন্দা কানাইচরণের সাথে। সিনিয়র ইন্সপেক্টর, গোয়েন্দাবিভাগ, লালবাজার। এই লোকের স্পেশালিটি হচ্ছে তিনি বেজায় সাধারণ! বিশ্বাস করেন, এটাই স্পেশালিটি। পরীক্ষা দিয়ে, ট্রেনিং করে, সিনিয়র গোয়েন্দার চ্যালাগিরি করে শেষমেশ টাইটেল পেয়েছেন গোয়েন্দার। বিশেষ পাওয়ার মধ্যে পেয়েছেন জাস্ট একটা 'ক্ষুরধার ব্রেইন'। বয়সও শেষদিকে চাকরির। চাকরি না থাকলে শখের গোয়েন্দাগিরির শখও নাই, পেনশন খাবেন এমনই প্ল্যান। গাট্টাগোট্টা, নিপাট সাধারণ গোছের এই গোয়েন্দাকে নিয়ে তার স্ত্রীও টিপ্পনী কেটে বলেন, তাকে নাকি ক্যাশিয়ার বা রিপোর্টার হিসেবেই বেশি মানায়, ওই গোয়েন্দা শব্দটা তার সাথে যায়না। তার কেস গুলোও কেমন, না ধুম-ধাম একশন, না তুমুল রক্তারক্তি, না স্পাইগিরি...কিছুই না। হারানো জাহাজ খুঁজছেন, সস্তা ভাতের হোটেলে বিষক্রিয়ার সূত্র খুঁজছেন, হাজারে বাজারে মুন্ডুকাটা চড়াইয়ের হত্যাকারী খুঁজছেন। এহেন সাধারণ কেসগুলো পুরো নিয়ম মেনে, বাই দ্য বুক খেলে, ট্রেনিং এ পাওয়া কেস সলভিং জ্ঞান দিয়ে কিইবা আর ইন্টারেস্টিং গল্প হয়? এখানেই কানাই বাবুর খেল। সঠিক প্রশ্নটি করতে জানেন তিনি। কেস সলভিং এর ব্যাসিক রুল what, when, where, why, who, how উত্তরগুলো খুঁজে বের করা একটি কেস থেকে। সেই ক্লাসিক নিয়ম মেনেই কেস সলভ করেন কানাইচরণ। থ্রিল ছাড়াই গোয়েন্দা কাহিনীর যে বিশেষ সৌন্দর্য আছে, তা তিনি তুলে এনেছেন। পুরো ব্যসিক ১০১। এখানকার চড়াই হত্যা রহস্যের কথাই যদি শুধু বলি, পাখির মতো নীরিহ প্রাণ সামনে রেখে তিনি যে গভীর ম্যাসেজ দিলেন, নিতান্ত ভালো রিসার্চ ছাড়া এরকম গল্প লেখা কঠিন। লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক কে ধন্যবাদ। অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে ক্লাসিক গোয়েন্দা বই পড়লাম। স্লো বার্ণ গল্প, ব্যক্তিজীবনের কম কচকচানি...ওই শুধু হালকা বউয়ের টিপ্পনি আর অফিসের দিদিমণিকে নিয়ে একটু ফ্যান্টাসি। চলে যাই শার্লকের উদ্ধৃত প্রথমে বলা সেই কোটেশনে, যেটা ব্যাখ্যা করে আমার পুরো আলাপ। তৃণময় দাস দাদাকে ধন্যবাদ বইটির সন্ধান দেবার জন্য। 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' পড়বার জন্য এখন মরে যাচ্ছি!
দারুণ!এক কথায় অনবদ্য! আমার মনে হয় গোয়েন্দা গল্পে প্রধান তিনটি বিষয় থাকে— চরিত্র,রহস্য ও রহস্যভেদ।এই বই তিনটি বিষয়েই ফুল মার্কস পেয়ে যায়।সাথে যোগ করছি অপূর্ব লেখনশৈলী। গোয়েন্দা কানাইচরণকে খুবই উপভোগ করলাম।লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ। কানাইচরণের আরো অনেক অনেক কাহিনি পড়তে চাই।
অনেক সময় লাগিয়েছি পড়তে। কারণ কেন যেন গল্পগুলা টানেনি। বেশি প্যাঁচালো মনে হয়েছে। আমার ভালো লাগেনি বলে আপনার লাগবে না তা তো না, তাই একটা ট্রাই করতেই পারেন যেহেতু অনেক মানুষের ভালো লেগেছে।
দুর্দান্ত তিনটি রহস্য বড়গল্প ও নভেলা নিয়ে কলকাতা নুয়া বইটি। মূল চরিত্র গোয়েন্দা কালিচরন। বইটার খোঁজ পেয়েছিলাম হইচই-এ ব্যাধ মিনি সিরিজটা দেখতে গিয়ে। পড়ার সময় পুরোপুরি ভিন্ন আঙ্গিকে আবিষ্কার করলাম গল্পগুলোকে। ব্যাকরণের বাইরে গিয়েও গোয়েন্দাগল্প লেখা যায় এই বইটি তার প্রমাণ। হারানো জাহাজের রহস্য, ভাতের হোটেলে হত্যা, সিরিয়াল কিলারের একনাগাড়ে চড়াই খুন এরকম বৈচিত্র্যময় কনসেপ্ট নিয়েই লেখা গল্পগুলো। সেইসাথে গোয়েন্দা কানাইচরনের তদন্ত পদ্ধতিও ভিন্নধরনের। উপস্থিতবুদ্ধি ও বিচক্ষণতার ওপর ভর করে এগোন এই গোয়েন্দা মহাশয়। গল্পগুলোতে নজর দেয়া হয়েছে মূলত বুদ্ধির খেলা খেলে অপরাধীর কাছে এগোনোর দিকেই। তেমন টুইস্ট নেই। গল্পগুলোতে টুইস্ট হল অপরাধীর মোটিভ। কারোর মোটিভ যে এমনও হতে পারে ভাবাই যায় না! একেবারে সুখপাঠ্য গোয়েন্দা গল্প। কানাইচরনের ভক্ত বনে গেলাম। রিকমেন্ডেড।
এই প্রচণ্ড কঠিন আর অস্থির সময়ে একমাত্র চিরচেনা বন্ধু হিসেবে বইকেই আঁকড়ে ধরে আছি। বই কেনা আর বই পড়ার সময় বার করতে পারার অনেকদিনের অসাম্যের ফলে পড়া-বাকি এমন বই বহু জমে আছে, এই একটা সুবিধে।
সবকটি যে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে তা নয়। কখনও লেখায় টান অনুভব করছি না, কখনও লেখা খারাপ না হলেও বই ছাপার আগে প্রুফরিডিং-এর ভয়ংকরী অনুপস্থিতিতে পড়ার ইচ্ছে চলে যাচ্ছে। ধৈর্য বড়ো কমে গেছে এসব বিষয়ে আজকাল, আগে হলে সে যেমনই লাগুক হয়তো জেদ ধরে শেষ করতুম, আজকাল সরিয়ে রেখে দিই। এমনিই সময় পাই এত কম, একটুও আর নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না।
তারপর এই বইটি পড়তে শুরু করলুম। কিছুটা পড়ার পর মনে হল এ লেখা চেয়ারে বসে পড়ে সুখ হচ্ছে না, তখন বেশ তাকিয়া বালিশ নিয়ে গুছিয়ে বসা গেল।
না, একটানে শেষ করিনি। একেবারেই না। বরং রোজ রাত্রে ঘুমোনোর আগে বেশ কিছুটা পড়ে আবার তুলে রেখেছি পরের দিনের জন্য। যাকে বলে রয়েসয়ে, তারিয়ে তারিয়ে পড়া।
কেন? দেখুন, স্পষ্ট কথাই বলি। ব্যাপার হল, ডিটেকটিভ গল্প নিয়ে আমার পাঠক হিসাবে বেজায় খুঁতখুঁতানি আছে। এ বইটা কিনেও এতদিন ফেলে রাখার কারণও সেটা, কেমন হবে তা নিয়ে সন্দেহ ছিল।
রাজর্ষি সে সন্দেহ রীতিমতো নিপুণভাবে নিরসন করেছেন।
ডিটেকটিভ বলতে আমরা যেরকম ভেবে থাকি, সাধারণত, বেশ একটা আলাদা উপস্থিতি,ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব, চলা-বলা সবেতে তাক লাগিয়ে দেওয়া নায়ক/নায়িকা একজন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে ত��ঁদের শরণাপন্ন হয় স্বয়ং পুলিশ - গোয়েন্দা কানাইচরণ চরিত্রটি তার একদম বিপরীতে অবস্থান করে।
জুনিয়রের ঘাড় ভেঙে সিগারেট খাওয়া, অফিসের সাসপেনশন অর্ডার উঠে যাবার অপেক্ষায় বসে বসে পুরোনো ফাইলের কেস সলভ করা, উঠে গেলে আর্দালির স্যালুট করা দেখে খুশি হওয়া, অফিসের পর প্রিয় আস্তানায় বসে দুপাত্তর খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা – প্রতি পদেই মনে হয় কানাইচরণ খুব চেনাপরিচিত একজন মানুষ।
এবং তিনি নিজেই একজন পুলিশ অফিসার। তাঁর তদন্ত পদ্ধতিতেও সেজন্য ঘনঘোর অ্যাকশনের ও রোমাঞ্চকর খুনজখমের বদলে এসেছে ফাইল, রিসার্চ, নিয়মনিষ্ঠ চেকিং ও ক্রস চেকিং এবং অবশ্যই যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে প্রতিটি ধাপ পেরোনোর মুন্সিয়ানা। পাঠককে থ্রিলড করা নয়, পাঠককে সঙ্গে নিয়ে গল্পের পরতে পরতে রহস্যের ভাঁজ খোলা, তাও বেজায় তৃপ্তিদায়ক মজলিশি ঢং-এ।
এখানেই গল্পগুলির সৌন্দর্য। সৌন্দর্য শব্দটা খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করলাম, কারণ লেখকের আত্মপক্ষ শুরুই হচ্ছে এই কথাগুলি দিয়ে – “গোয়েন্দা কাহিনির একটি বিশেষ সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য তার রহস্যের সৌন্দর্য। কবিতার ধারণা না থাকলে অনুমান করি এই সৌন্দর্যকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যায় না।“
লেখকের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। পড়তে পড়তে ব্যোমকেশ মনে পড়েছে, ফাদার ব্রাউন মনে পড়েছে – যদিও কানাইচরণ ও তাঁর তদন্তের ভুবন এই মহারথীদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। এই মনে আসা সম্ভবত ঐ সৌন্দর্যের উপস্থিতির জন্যই।
আর না, বইটিতে তিনটি গল্প আছে – ছোট্ট করে সেগুলোর কথা বলে চুপ করব।
কালাপানির দিশা – হাতে কাজ নেই, সাসপেনশন না ওঠা অবধি নতুন ফাইল পাবেন না। অগত্যা পুরোনো ফাইল ঘেঁটে নিজের বুদ্ধিতে সমাধান খুঁজে সময় কাটাচ্ছেন কানাইচরণ। হাতে এল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের এক জাহাজডুবি ও বন্দি উধাও রহস্যের ফাইল। সত্যি কী হয়েছিল, তা পর পর যুক্তি মেলে যখন সাজিয়ে ধরলেন তিনি, পাঠক মুগ্ধ হবেই। অত্যন্ত ভালো লেগেছে।
পাইস হোটেলে হত্যা – পরের পর সাধারণ, অসম্পর্কিত মানুষ মারা যাচ্ছে কলকাতার পাইস হোটেলে। কেন? এ কি নতুন কোনও সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব? পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল পথ হল মানুষের মনের গলিঘুঁজি। এই গল্পে অপরাধ এবং অপরাধীকে ধরার পন্থা, দুই-ই হেঁটেছে সেই গলিঘুঁজির আলো-অন্ধকার জুড়ে। মনস্তত্ত্বনির্ভর এত ভালো কিছু বহুকাল পড়িনি।
চড়াই-হত্যা রহস্য – স্টোনম্যানের পর আরেক সিরিয়াল কিলার এসেছিল বাংলায়। কিন্তু মানুষ নয়, সে খুন করত শুধুই চড়াইপাখিকে। যেমন তাজ্জব করে দেওয়া অপরাধ, তেমন অভাবিত রাস্তায় তার সমাধান। না, অভাবিত মানে অবাস্তব কিছু নয়। বরং কোনও চমক ছাড়াই রুটিন জেরা, খবর জোগাড় করা, ভিজিট, ঘোরাঘুরি, পুরোনো কাগজপত্র-নথি ঘাঁটা, সিরিয়াল কিলারদের সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইলিং, এই অপরাধের পিছনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া, চড়াই নিয়ে পক্ষীবিশেষজ্ঞর মতামত নেওয়া – পুরোপুরি , একেবারে যাকে বলে রুলবুক ধরে তদন্ত - গল্পের সিংহ ভাগ জুড়ে এসেছে এই প্রোসেস (যা সাধারণত সমস্ত গোয়েন্দা গল্পেই পাঠকের চোখের আড়ালে থাকে)। জমাটি, একটুও বোর হতে না দেওয়া বর্ণনা। মনস্তত্ত্ব ছাড়াও এই প্রোসিডিওরাল ডিটেকশনের সঙ্গী হতে পারা এই গল্পের একটা মস্ত বড় পাওনা।
বইটি সুমুদ্রিত, সুন্দর রুচিশীল প্রচ্ছদ। এককথায়, আগাগোড়া চমৎকার। ভবিষ্যতে রাজর্ষির কলমে কানাইচরণের আরও গল্পও পড়তে পারব, সেই আশায় রইলুম।
---
বই – কলকাতা নুয়া লেখক – রাজর্ষি দাশ ভৌমিক প্রকাশক – বৈভাষিক মুদ্রিত মূল্য – ২৮০/-
বইটার ভালো দিক হচ্ছে - যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে পরিবেশ সাজানো হয়েছে; বিশেষ করে পুলিশি আমলাতন্ত্রের ঘোরচক্কর, ক্যাজুয়াল ক্রুয়েলটি, ডিপার্টমেন্ট-দের মাঝে সচেতনভাবে ভারসাম্য রেখে সৃষ্টি করা আন্তঃসম্পর্ক - এসব দেখে মনে হবে কানাইচরণ সত্যিই ডিটেকটিভ; সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। লেখককে অভিবাদন। এরকম করতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক উত্তম প্লটের বাঁধ আলগা হয়ে গ্যাছে শুধু বিশ্বাসযোগ্যতা তৈয়ারি করতে না পারায়, এখানে লেখক নিখুঁত।
এবার আসি প্লটে। এই জায়গায় অনেক ভুরূ কুঁচকাবার জায়গা। প্রথম গল্পে যেটা সমাধান হিসেবে আনা হয়েছে সেটা বড়জোর কষ্টকল্প থিসিস হতে পারে, বাস্তবের সাথে খুবেকটা কানেক্টেড মনে হয়নি। আসামির মাসতুতো ভাইকে মাসুদ রানার চেয়েও সেয়ানা হিসেবে দেখানো, বিশ-পঁচিশটা মানুষকে খুন করে, জাহাজ চালিয়ে পগারপার হয়ে যাওয়া - অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি। তবে কানাইচরণের রিসার্চ করার মেথড উপভোগ্য।
দ্বিতীয় গল্প সুন্দর। আসামির মোটিভ পরিষ্কার বুঝিনি, এছাড়া টিপটপ।
তৃতীয় গল্পেও লজিকের লাফ বড্ড বেশি হয়ে গ্যাছে শেষটাতে। এত সহজে বুঝে ফেলা যে এটা আত্মহত্যার ফেইলড এটেমপ্ট - এর সপক্ষে শক্তিশালি যুক্তি দেওয়া হয় নি।
আহা এমন বৈঠকী গোয়েন্দা গল্প অনেকদিন পড়িনি। এরকম লিখলে জনরা ফিকশনের প্রতি আমার আনুগত্য অটুট থাকবে আর মাতৃভাষার সাথে আশনাইও বাড়বে। পরের বইটাও শীঘ্রই কিনতে হবে যা দেখছি।
প্রাইভেট গোয়েন্দার বাইরে এই প্রথম পুলিশ গোয়েন্দা নিয়ে কোন কাহিনী পড়লাম। সরকারী তদন্ত,আমলাতন্ত্র, সিনিয়র অফিসার কিংবা বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে কিভাবে একটি তদন্ত এগোয়, সরকারী জনবলের অভাব সত্তেও কিভাবে তদন্তের কাজ হয় মোটকথা পুলিশ প্রসিডিউরাল নিয়ে এই বইয়ের তিনটি কাহিনী। গোয়েন্দা কানাইচরন অতিমানবীয় গুন না নিতান্তই বেসিক গোয়েন্দাগিরির ব্যাকরণ, উপস্থিতবুদ্ধি ,বিচক্ষণতা, পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতা এই মিলিয়ে তদন্ত সমাপ্ত করেন। কলকতা নুয়ার তিনটি গল্প – কালাপানির দিশা, পাইস হোটেলে হত্যা, আর চড়াই-হত্যা রহস্য। কালাপানির দিশা আমার কাছে ভাল লাগেনি, জোর করে মিলানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। পাইস হোটেলে হত্যা গল্পটা মোটামোটি লেগেছে, আসামির মোটিভ টা বুঝতে পারলে আরেকটু ভাল লাগত। চড়াই-হত্যা রহস্য এই নভেলাটা খুব ভাল লেগেছে। অসাধারন!!! এই নভেলা পরেই আমি গোয়েন্দা কানাইচরন এর ফ্যান হয়ে গেলাম।
গোয়েন্দা কানাইচরণের গল্পগুলোতে এক ভিন্ন ধরনের আবেদন আছে। কাহিনিগুলো সরস, বাস্তবধর্মী এবং বাহুল্যবর্জিত। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্রসমূহের আভিজাত্যে কানাইকে ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অবশ্য এখানে লেখকেরও কর্তব্য হিসেবে কানাইয়ের রিটায়ারমেন্টের আগেই পাঠকদের পাতে দু-চারেক গল্প তুলে দিলে মন্দ হয় না!
"গোয়েন্দা কাহিনির একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য তার রহস্যের সৌন্দর্য।"
তিনটে খাস্তা মুচমুচে গোয়েন্দা গল্প। কিন্তু গল্পগুলোর ধাঁচ একরকম নয়, একে অপরের থেকে আলাদা। কেসগুলোও ঠিক ভয়ানক কিছু নয়। কোনও বিশাল চক্রান্তের খোলসা হয় নি, কেউ নৃশংস ভাবে খুন হয় নি, রক্তের ফোয়ারা উঠে ট্যারেন্টিনোগিরি দেখান হয় নি, গুলি চলেনি, কারুর মূর্তি চুরি যায় নি, হঠাৎ কোনও নেমেসিসের আবির্ভাব হয় নি৷ গল্পের গোয়েন্দা লালবাজারের কানাইচরণ নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। তামাদি কেস ঘাটাঘাটি, অফিসের এক দিদিমণিকে নিয়ে অল্প রোমান্সের ফ্যান্টাসি, অফিস হাওয়ার্সের পর মাঝে মাঝে সেসিল বারে গিয়ে গলা ভেজানো: এইসব নিয়ে তাঁর দিন কাটে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই নাকি রিটায়ার হবেন। কিন্তু এই অতি-স্বাভাবিকতার মধ্যে একটা ক্ষুরধার বুদ্ধি লুকিয়ে রয়েছে।
মাইরি বলছি, এইরকম অদ্ভুত সংকলন আগে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। প্রথম গল্পটা পড়ে, একটু একটু "সূর্যতামসী"-এর গন্ধ পাচ্ছিলাম, কিন্তু দ্বিতীয় গল্পের মাঝামাঝি আসতেই বুঝে গেলাম, " কলকাতা নুয়া" অন্যধরণের একটা বই, যেখানে কোনরকম জনরার ককটেইল না করে, তথ্যভারে পাতার সংখ্যা না বাড়িয়ে, রাজর্ষি দাশ ভৌমিক গোয়েন্দা কাহিনীর বেসিক এলিমেন্টে ফিরে গেছেন। কেসগুলো উদ্ভট হতে পারে, কিন্তু সলভড হয়েছে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে।
অর্থাৎ, ভয়ানক থ্রিলার পড়তে চাইলে এই বইটা থেকে দূরে থাকুন। কিন্তু একটা লোক বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে কী করে কেস সলভ করে, সেটা দেখতে হলে বইটা লুফে নিন। একেবারে সোনার খনি।
আরেকটু খোলসা করি।
প্রথম গল্প "কালাপানির দিশা"। আস্ত একটা জাহাজ অন্তর্ধান রহস্য, তাও ১০০ বছর আগে। না, বার্মুডা ট্রায়াঙ্গলে না, খোদ বঙ্গোপসাগরের মাঝখান থেকে। এই গল্পটা আমার সবথেকে প্রিয়, কারণ এই তামাদি কেস সলভ করার জন্যে পুরনো ঐতিহাসিক নথিপত্র ঘাটা ছাড়া উপায় নেই। ভাবছেন এই কেস আবার কী ভাবে সলভ করা সম্ভব? আর করারই বা দরকার কী? সেটা কানাইচরণ জানিয়ে দেবেন।
দ্বিতীয় গল্প "পাইস হোটেলে হত্যা।" নামেই বোঝা যাচ্ছে কী হয়েছে, তাই আর কেসের কথা বললাম না। এই গল্প পড়ে রাজর্ষিবাবুর লেখনীর প্রতি আমার গভীর আস্থা জন্মেছে। পাইস হোটেলের বিবরণ, অলিগলির বর্ণনার মধ্য দিয়ে কলকাতা শহরকে তিনি বইয়ের পাতায় জীবন্ত করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। এছাড়াও কলকাতা পুলিশের প্রোসেডিওর বেশ বাস্তবসম্মত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তৃতীয় গল্প "চড়াই-হত্যা রহস্য"। এই কেসটা কানাইচরণবাবুর প্রথম দিককার কেস, ১৯৯৮-এর দিকে। কে বা কারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে চড়াই পাখি মেরে বেড়াচ্ছে। একটা দুটো নয়, শয়ে শয়ে। আঁকশি জাতীয় কিছু দিয়ে গলা চিড়ে দিচ্ছে। ঠান্ডা মাথায় খুন আর কি। কানাইচরণ সিআইডির যৌথ সহায়তায় এই সিরিয়াল কিলারকে খোঁজার চেষ্টা চালান। কিন্তু সেই খোঁজ তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার থেকেও কঠিনতম কাজ!
এই কেসগুলো কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটা তামাদি কেস, একটা ছোট হোটেলে দুইজন লোকের মৃত্যু, আরেকটাতে তো কোনও মানুষই আহত হয় নি। তবু রাজর্ষিবাবু তাঁর সুন্দর পরিবেশনের মাধ্যমে আমার মনের ক্ষুদা মেটাতে সমর্থ হয়েছেন।
পুনঃ এহেহে, অনেকগুলো খাবার নিয়ে মন্তব্য করা হয়ে গেল। আসলে ওই মিক্সড পকোড়া হয়েছে কাল...
গোয়েন্দা গল্প পড়তে বসা আর ক্যাসিনোতে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করার মধ্যে বেশি তফাৎ নেই। ভাগ্য প্রসন্ন হলে পকেট ভারী হতে পারে অথবা চিত্ত চঞ্চল হয়ে দিনটা রোমাঞ্চকর হয়ে উঠতে পারে, আবার ঝুঁকিও কম নয়। বেগতিক দেখলে মাঝখান থেকে সটকে পড়া চলে না, কারণ এই দুই বস্তুর নেশা করা ব্যক্তি মানেই জানে, সেই অবকাশ অথবা মানসিক পরিস্থিতি আমাদের থাকে না।
কলকাতা নুয়ার আপাদমস্তক গোয়েন্দা কাহিনী, ডিটেকটিভ ফিকশনের ক্লাসিক নিয়ম মেনে রচিত স্মার্ট রিড। ইতিমধ্যেই এই বইটা পাঠক প্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যে বাংলায় এমন ঝানু গোয়েন্দার আবির্ভাব ঘটেনি, সেই নিয়েও কোন সংশয় নেই।
বইয়ের তিনটে গল্পে একটা হল ' কালাপানির দিশা'। ভাগ্যক্রমে এই গল্পটা আগেই কালি ও কলম ওয়েব ম্যাগাজিনে পড়ে ফেলেছিলাম এবং দারুণ উত্তেজিত হয়ে ' মচৎকার ' বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তার অবশ্য যথাযথ কারণ ছিল। এত ভাল বাংলা গোয়েন্দা গল্প আমি আদপেই পড়েছি কী না সন্দেহ আছে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে নিখাদ গোয়েন্দা গল্প পড়ে। ব্যোমকেশ আর ফেলুদা যেমন গিলেছি, হালের গোয়েন্দাদের রান্নাও চেখে দেখেছি। বলতে সঙ্কোচ হলেও কয়েক বছর ধরে রান্নার স্বাদে আমার মন মোটেও ভরছে না। প্রযুক্তি সম্পর্কে আপডেটেড হলেও গোয়েন্দা গল্পের চার্ম মিসিং, ফলে দু তিনটে জায়গায় একটু ঝিলিক মারলেও পুরোটা পড়ে তেমন মেজাজ আসে না। তাতে একটা লাভ হয়েছে যে, খাদ্যের সন্ধানে অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে একটু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছি। জানিয়ে রাখি, বেনারসি লস্যি বলে ঘোলের শরবত খাওয়ানোর জালসাজি সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে, ফলে ভাগ্যে না থাকলে ভাল জিনিস বাজারে থাকলেও পাতে পড়বেই, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
এই যে আমি কাজের কথায় না এসে উল্টোপাল্টা বকে চলেছি ক্রমাগত, এই অভ্যেস থাকলে গোয়েন্দা গল্প লেখার চেষ্টা না করাই ভাল। ডিটেকটিভ ফিকশনের প্রধান শর্ত হল, ব্যাপারটা আগাগোড়া ক্রিস্প হতে হবে ( এখানে বলে রাখি, থ্রিলার আর ডিটেকটিভ ফিকশন আমি পৃথক ভাবেই দেখছি)। মিস মারপল থেকে ফেলুদা, প্রত্যেকেই মনে হয় শর্তাবলীর এই পয়েন্টটা পদে পদে মেনে চলেছেন ফলে ফাঁক ফোকর থাকলেও গল্প উতরে যেতে অসুবিধে হয়নি।
এইবার আরেকটা অসুবিধে আছে, আর সেটাই প্রধান। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পাঠকদের বড্ড বাড় বেড়েছে, সেইজন্যে অর্ধেক প্লটের বিষয়বস্তু দেখেই তাদের হাই ওঠে। অথচ জম্পেশ একটা প্লট না থাকলে লেখার কোন মানেই হয় না ( লেখার গুণে সাধারণ প্লট অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে, সেটা বুঝিয়ে লাভ নেই। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ি থেকে গয়না চুরি হওয়ার ঘটনার মধ্যে যত অসাধারণ উপাদান থাক না কেন, প্লট শুনলেই পাঠক হাই তুলতে পারে। ও জিনিস পড়ে পড়ে আমরা ক্লান্ত) সেই দিক থেকে দেখতে গেলে লেখক শুভেচ্ছার পাত্র, কারণ বইয়ের তিনটে নভেলাই চেনা পথে হাঁটেনি। অভিনব প্লট থাকলেও সেই অভিনবত্ব কে ধরে রাখার মুনশিয়ানাও সকলের থাকে না, এক্ষেত্রে লেখকের সেটা ভরপুর আছে।
বইটার তিনটে গল্প হল -
১. কালাপানির দিশা ২. পাইস হোটেলে হত্যা ৩. চড়ুই হত্যা রহস্য
হ্যাঁ, নামগুলো কৌতূহল উদ্রেককারী ঠিকই। কিন্তু গল্পের প্লট সম্পর্কে আমি কিছুই লিখতে চাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রথম গল্পটা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে। অন্য দুটো লেখাও যথেষ্ট ভাল, তবে দু এক জায়গায় হোঁচট খেয়েছি। সেটা এমন কিছু নয়।
গল্পের নায়ক কানাইচরণ লালবাজারের অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, তাই কলকাতা পুলিশের প্রসিডেরাল সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট চিত্র আঁকা প্রয়োজন ছিল। পুলিশ প্রসিডেরাল মানেই যে শুধু ফরেনসিক আর প্রযুক্তির লাফালাফি আর ঢিংচ্যাক একশন থাকবে, সেটা একেবারেই ভুল। খুব সম্ভবত প্রথম কেউ মন দিয়ে পুলিশের রোজকার কাজকর্ম আর ডিপার্টমেন্টাল ক্রাইসিস নিয়ে লিখল, সেই জন্যে রাজর্ষি কে একশ ব্রাউনি পয়েন্ট একস্ট্রা দিলাম।
আমার যেটা ভয়ের জায়গা ছিল, সেটাও লিখেই ফেলি। লিটারারি ফিকশনের লেখকদের ভাষা আর স্টাইল একেবারেই ভিন্ন, কোন কোন ক্ষেত্রে গোয়েন্দা গল্প লিখতে এসে তাঁরা প্রায় সাইকো সোশ্যাল ড্রামা লিখে ফেলেন। চরিত্রদের ব্যাক স্টোরি আর সামাজিক জীবনের কচকচি নিয়ে এমন ভ্যানতারা করেন, তাতে আসল রহস্য চলে যায় নেপথ্যে ( এই নিয়ে অবশ্য মতবিরোধ আছে, মার্কিন ক্রিটিক ভ্যান ডাইন লিখেছিলেন, "“a detective novel should contain no long descriptive passages, no literary dallying with side-issues, no subtly worked out character analyses”. আবার উইলকি কলিন্স এর গোয়েন্দা উপন্যাস দ্যা মুন স্টোন পড়ে ইলিয়ট সেই দীর্ঘ চরিত্র চিত্রণ আর লিটারারি স্টাইলের হেবি তারিফ করেন)। গোয়েন্দা সাহিত্যে এই মারাত্মক ভাইরাস ঢুকলেই কাম খতম, পুরো চানাচুর চটকে চপ্পল হয়ে যায়। এই ভয়ে আমি হুটহাট করে সিরিয়াস লেখকদের লেখা গোয়েন্দা গল্প কিনতে পাঁচ বার ভাবি। রাজর্ষি কয়েকদিন আগেই ' পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর' লিখেছেন, ফলে ভয় না থাকলেও কিন্তু কিন্তু ভাব একটা ছিলই। ভাগ্য ভাল, লেখকের দুটো সত্তা কোথাও মিশে যায়নি, ফলে গোয়েন্দা গল্পের সাবলীল ভাষা ও গতিতে এক মিনিটের জন্যও ছেদ পড়েনি।
সংক্ষেপে জানাই, বইয়ের প্রতিটা গল্পই তুখোড়। টানটান রহস্যে ভরপুর ধারাবাহিক তদন্তের মাঝে মাঝে ফরেনসিক, ইনফরমার এবং প্রোফাইলরদের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুরধার সংলাপ আর কমিক রিলিফ ও আছে, আর আছে পুরোপুরি কলকাতা মেজাজে। ফলে পাঠকের হেদিয়ে পড়ার কোন চান্স নেই।
কিন্তু, একটা কথা বলে রাখা ভাল, রহস্যের সমাধান করতে গেলে খুব একটা সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। গোল্ডেন যুগের ডিটেকটিভ ফিকশন বইয়ে 'fair play' বলে একটা অলিখিত নিয়ম চালু হয়েছিল, যাতে মনযোগী পাঠক গোয়েন্দার পাশাপশি নিজেও রহস্য সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। ফেয়ার প্লে না থাকলে বহু উপন্যাসকে খেলো বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, এরকম ঘটনাও আছে। গোয়েন্দা লেখকদের উদ্দ্যেশ্যে বলা থাকত, “the character and motives of the criminal should be normal.”
নরমাল যে এখানে আসলে অবভিয়াস, তাতে সন্দেহ নেই। শার্লক হোমস আসার পর এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়, অপরাধীর মোটিভ অথবা উদ্দেশ্যে যে খুব আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক হবে, সেটা জরুরি নয়। এখানেও সেই একই কথা বলব, এ বড় সরল রৈখিক তদন্ত নয়। মোটিভ বুঝে উঠতে গেলে হেঁচকি উঠতে পারে, সেই চেষ্টা না করাই ভাল।
এই জায়গা থেকেই গল্পের কয়েকটা জায়গা আমাকে একটু চিমটি কেটেছে। (দ্বিতীয় গল্পে মোটিভ এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। আবার তৃতীয় গল্পের একটা প্রসঙ্গ, যেখানে একজন প্রথম অপরাধীকে চিহ্নিত করছে, সেখানেও একটু সন্দেহ উঁকি দিয়েছে)।
এছাড়া কলকাতা নুয়া অসাধারণ, অনবদ্য এবং অনন্য। গোয়েন্দা গল্পের পাঠক হলে অবিলম্বে পকেটস্থ করুন।
কলকাতা নুয়া পড়লাম গোয়েন্দা কিছিমের কাহিনি তবে গৎবাঁধা গোয়েন্দা কাহিনি না। শার্লক, বোমকেশ বা ফেলুদা গোছের তো একদম নয়ই। লেখক বলে গেছেন একদম নিজস্ব স্টাইলে। যেমনি বিকেলবেলা বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক দাদু নদীরপাড়ে বসে আগের দিনের গল্প পাড়তেন!
একটা স্লো বার্ন টাইপ মুভি যেমনে আগায় আরকি। খামছে ধরার ব্যাপার আছে। পুলিশি তদন্ত বাস্তবিকতার ছোঁয়া আর কথোপকথনে একটা মজলিশি ভাব আছে। হিউমার সাধারণ তবে সিনের সাথে জমে যায়।
সলিড ৫ স্টার প্রাপ্ত বই। পাইস হোটেলে হত্যা আমার প্রিয় গল্প তিনটি গল্পের মধ্যে।সবচেয়ে ভাল লেগছে প্রোটাগনিস্ট কানাইচরন কে।কোন হিরোইজম দেখানো হয়নি,সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে চরিত্র টি কে।"একাই সব করতে পারি " এমন মনোভাব প্রোটাগনিস্ট এর মধ্যে দেখানো হয় নি।এটাই সবচেয়ে ভাল লাগার বিষয় ছিল এর সাথে সাথে পুলিশ প্রসিডিওরাল মিক্সার,হিউমার মিলিয়ে দারুণ একটা বই।
রাজর্ষি দাশ ভৌমিক কলকাতা নুয়া -২৮০/- বৈভাষিক কানাইচরণ দাস। নাম শুনলেই একজন অকিঞ্চিৎকর গোবেচারা মানুষের কথা মাথায় আসে। এই নামটির সাথে পরিচয় ঘটে লেখক অন্বয় গুপ্ত'র লেখা একটি review পড়ে। লেখাটিতেই প্রথম রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এর 'কলকাতা নুয়া' ও 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' বই ২টির উল্লেখ পাই। সেই review পড়েই মনস্থির করেছিলাম এই ২টি বই সংগ্রহ করে পড়তেই হবে। কাকতালীয় ভাবেই এই ঘটনার কয়েক মাস পরে হইচই তে 'ব্যাধ' নামের একটি series আসে। জানতে পারি, যে গল্পটির ওপর নির্ভর করে ওটা বানানো হয়েছে সেটার নাম 'চড়াই হত্যা রহস্য'; এবং যা 'কলকাতা নুয়া'র অন্তর্গত। অনেক দোটানার পর, পড়ার আগে দেখেই ফেলি সিরিজটা। গোয়েন্দা গল্প কিন্তু আদ্যন্ত নতুন স্বাদের। নিখাদ পুলিশি তদন্ত তাও যেনো বিনোদন জগতে অভিনব। ভালো লাগলো দেখে। মাসখানেকের মধ্যেই কিনে ফেলি বইগুলো এবং পড়ে শেষ করি। আমার মন থেকে একটা তীব্র তাগাদা পেয়ে যাবতীয় ল্যাদ কাটিয়ে ফেলে এই পাঠ প্রতিক্রিয়া টা লিখতে বসেছি। গৌরচন্দ্রিকা টি আর দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই। লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক এর লেখার সাথে আমার পরিচয় কলকাতা নুয়ার মধ্য দিয়েই। লেখক, গোয়েন্দা গল্পের যে স্বতন্ত্র মাধুর্য্য; তাকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। আজকের দিনে থ্রিলার প্লট, মারাত্মক টুইস্ট কিংবা সিনেম্যাটিক ক্লাইম্যাক্স এর অনুপ্রবেশ ঘটায় গোয়েন্দা গল্পের যে একটা নিজস্ব স্বভাবসুলভ সৌন্দর্য আছে, তা হারাতে বসেছে। লেখক তাঁকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন এবং আমার মতে সফলও হয়েছেন। গোয়েন্দা কানাইচরন কোনো larger than life চরিত্র নন। তিনি লালবাজারের একজন পুলিশ গোয়েন্দা, যাঁর চাকরিজীবন প্রায় শেষের পথে অর্থাৎ retirement এ খুব বেশি দেরি নেই। সাগরেদ, জুনিয়র ইন্সপেক্টর সৌভিক যিনি স্বভাবতই কানাই এর থেকে অনেক বেশি চটপটে। তবে কানাই এর আছে দীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা, জটিল রহস্য অনুধাবনের উপযোগী অধ্যবসায় আর সূক্ষ বিশ্লেষনী ক্ষমতা। তিনি আর পাঁচটা পরিচিত সরকারী চাকুরীজীবির একজন, যিনি অফিসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুম দিতে পারেন, যিনি প্রায়শই সন্ধ্যায় সেসিল বারে এ গিয়ে মদ্যপান করেন, বাড়িতে গিন্নিকে একটু সমঝে চলেন এবং যাঁর রেকর্ড সেকশন এর দিদিমণির প্রতি একটু 'ইয়ে' আছে। কানাইচরণের প্রতিটি কাহিনীর যে বৈশিষ্ট্যটি আমার সবথেকে ভালো লেগেছে তা হলো, তদন্ত পদ্ধতির প্রবহমানতা। খুবই সাধারণ আর প্রয়োজনীয় ছোটো ছোটো পদক্ষেপ, রুটিন তদন্তের প্রতিটি ধাপ অতি যত্নে বুনেছেন লেখক। পুলিশি তদন্ত পদ্ধতির একটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবচিত্র পাঠক তথা সাধারণ নাগরিকের তুলে ধরেছেন তাঁর সাবলীল লেখনীর দ্বারা। এবার একে একে কাহিনী গুলোর ব্যাপারে একটু বলি-
'কলকাতা নুয়া' র প্রথম কাহিনী; 'কালাপানির দিশা'~ নানা কারণে বড়োকর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে department এ ক্লোজড হয়ে যান কনাইচরণ। লালবাজারে আসা যাওয়া করতে পারলেও তাঁকে কোনো casefile দেওয়া হচ্ছে না। এমতাবস্থায় নিতান্ত সবেতন ছুটি কাটানোর মেজাজে কানাইচরন অপেক্ষা করছেন কবে কোনো গুরুতর জটিল case আসে এবং তাঁর ছুটি শেষ হয়। তাই সময় কাটানোর তাগিদে রেকর্ড সেকশন এর দিদিমণির থেকে নানা পুরাতন unsolved কেসফাইল নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেরকমই একটি casefile কানাই এর হাতে তুলে দিয়ে দিদিমণি চ্যালেঞ্জ করেন একটি বিশেষ unsolved কেস সলভ করে দিতে। ১৯১১ সালের ঘটনা। একজন স্বদেশী বিপ্লবীর দ্বীপান্তর এর সাজা হওয়ায় তাকে নিয়ে 'জর্জ দ্য স্যভিওর' নামক একটি জাহাজ আন্দামানের উদ্যেশে রওনা দেয়। নিরাপত্তার তাগিদে, জাহাজে যে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই তথ্যটি বাইরে কোথাও প্রকাশ করা হয়না। বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ে এবং তার পরে জাহাজটি বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কোথাও আর সেই কয়েদী কি সেই জাহাজ কারো খোঁজ মেলে না। ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী তথা তৎকালীন পুলিশ বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। না কোনো জাহাজডুবির চিহ্ন, না কোনো জলদস্যু আক্রমনের সংবাদ, না কোনো ঝড় ঝঞ্ঝা। কোনোভাবেই মীমাংসিত হয়না, বঙ্গোপসাগরের এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের। প্রায় একশ বছরেরও বেশি সময় পরে কানাইচরন কিভাবে এই রহস্যের সমাধান করবেন সেটাই এই গল্পের বিষয়। আমার খুব আকর্ষণীয় লেগেছে গল্পের এই পটভূমিটা। দ্বিতীয় কাহিনী; 'পাইস হোটেলে হত্যা'~ কলকাতার এক পাইস হোটেলে নৈশভোজ সারতে এসে হঠাৎ করে খাবার টেবিলেই মৃত্যু হয় দুই কলেজ ছাত্রের। কানাই কে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই কেস এর। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু কিন্তু খাওয়ার এ কোথাও বিষ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন বাদেই আবার একটি অন্য হোটেলে খেতে বসে মারা যান আরেক ব্যক্তি। একই বিষ এ বিষক্রিয়া। হত্যাকারী কে! এটা কী কোনো সিরিয়াল কিলিং এর কেস? এই গল্পে তদন্ত পদ্ধতি খুব সুন্দর সাবলীলভাবে রচিত হয়েছে, গল্পের পটভূমিকাও নতুনত্বের ছাপ লাগানো তবে শেষে এসে কেমন যেনো হয়ে গেলো। আমার ব্যক্তিগত ভাবে এই গল্পের শেষটা ভালো লাগেনি। তবে পড়ে দেখলে হতাশ হবেন না খুব একটা। তৃতীয় কাহিনী; 'চড়াই হত্যা রহস্য'~ ব্যাধ সিরিজে দেখানো কাহিনীটা আসলে যে 'Tip of the iceberg' সেটা নভেলেট টা পড়েই উপলব্ধি করি। শুটিং এর তাগিদে মূল কাহিনীর বেশ কিছু মূল্যবান জায়গার রদবদল ঘটানো হয়েছে যা আমার মনে হয়, মূল কাহিনী বজায় থাকলে আরও আকর্ষণীয় হতে পারতো। এইটি আমার মতে এই সংকলনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী। একজন কিংবা একদল লোক বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে শয়ে শয়ে চড়াই পাখির গলা কেটে হত্যা করছে। একটি অদ্ভুত রকমের সিরিয়াল কিলিং এর case, কানাই যার সম্মুখীন হয়েছিল তাঁর চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে, যেখানে ভিক্টিম মানুষ নয়, চড়াই। সেশিল বারে বসে রেকর্ড সেকশনের দিদিমণি আর সৌভিক কে সেই কাহিনী শোনাচ্ছিলেন কানাইচরণ। বিভিন্ন লেয়ার আছে এই কেস এর তদন্ত পদ্ধতিতে; যায় অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে খোঁচড়দের অবদান। হ্যাঁ, লালবাজার গোয়েন্দাদের থেকে তাঁদের খোঁচড়দের নেটওয়ার্ক কিছু কম নয় বরং অনেকাংশেই বেশি। এর আগে কোনো ফিকশনে, পুলিশ এর খোঁচড়দের উল্লেখ আমি অন্তত পাইনি। খুব আকর্ষণীয়, নিখুঁত তদন্তের মাধ্যমে, নানান প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তরুণ গোয়েন্দা কানাইচরণ দাস কিভাবে এই চড়াই হত্যা রহস্যের সমাধান করেছেন, সেই বিবরণ না পড়লে সতি খুব মূল্যবান কিছু মিস করে যাবেন গোয়েন্দা গল্পপিয়াসী পাঠক-পাঠিকাগণ। অবশ্যপাঠ্য এই কাহিনী। আমি বলবো ভুলেও সিরিজ দেখে এই কাহিনীটা কে বিচার করবেন না। পড়ে ফেলুন।
এরপর আসি লেখকের কানাইচরণ কে লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, 'অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহাবশেষ উদ্ধার' এর বিষয়ে। এক কথায়, এটিই কানাইচরণ কে নিয়ে লেখা লেখকের সাম্প্রতিক কাহিনী হওয়ায় এর প্রতি আমার প্রচুর প্রত্যাশা ছিল; এবং লেখক সেই প্রত্যাশার মান রেখেছেন শুধু নয়, হয়তো আমার প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। কবীরগঞ্জে একটি নির্মীয়মান আবাসন এর ভিতজমি তে খননকার্য করার সময় শ্রমিকরা খুঁজে পান একটা নরকঙ্কাল। কিছুদিন আগেই কবীরগঞ্জ কলকাতা পুলিশের আওতায় এসে পড়ায় তদন্তের দায়িত্ব এসে পড়ে লালবাজারের সিনিয়র গোয়েন্দা কানাইচরণ এর ওপর। তদন্তে নেমে প্রথম কাজ ছিল, কে খুন হয়েছে সেটা খুঁজে বার করা এবং তারপর সেই সূত্র ধরে কেনো খুন হয়েছে এবং কে খুন করেছে তাকে খুঁজে বের করা। No doubt বেশ জটিল কেস। যেখানে ডেডবডি তে হাড় ছাড়া আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই সেখানে কে খুন হয়েছে খুঁজে বের করা মোটেও সহজ কাজ নয়, পশ্চিমবঙ্গের মতো স্থানে। তবুও সেই অসাধ্যসাধন করেছেন আমাদের অতি পরিচিত 'সাধারণ' গোয়েন্দা কানাইচরণ। লেখকের মতে কানাই নাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাতি-কেস নিয়ে কাজ করে থাকেন, তবে আমার মতে এরকম 'পাতি কেস' এ কানাই নিজের বুদ্ধিমত্তা আর প্রতিভার যে নমুনা প্রতিষ্ঠা করেছেন, আত্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে বারংবার নিজের গোয়েন্দা স্বত্তাকে যেভাবে প্রশ্ন করেছেন যে তিনি যা ভাবছেন তাতে কোনো খুঁত আছে কিনা, তা সত্যি প্রশংসনীয়। এই নির্মাণকার্যের জন্য লেখককে সহস্র কুর্নিশ। হ্যাঁ, এই কাহিনীর শেষে একটি চমক রয়েছে তবে তা মারাত্মক প্লট টুইস্ট গোছের কিছু নয় বরং বলা যেতে পারে সমাপ্তির চমক। যেভাবে সমাপ্তি রচনা হয়েছে তাতে এই কাহিনী আর পাঁচটা গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে ভীষণ স্বতন্ত্র হয়ে এক উচ্চ আসন লাভ করবে নিঃসন্দেহে। অত্যন্ত জমজমাট একটা লেখা, সুখপাঠ্যও বটে। রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের কানাইচরণ সিরিজ বাংলা গোয়েন্দা জগৎ কে একটা নতুন দিশা দেখাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এ লেখা চলতে থাকুক, আমি মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছি কানাইচরন কে, সৌভিক কে, লালবাজার কে। অতি সাধারণ এক সরকারী গোয়েন্দা যাঁর গল্পে কোনো অত্যাশ্চর্য বা অতিপ্রাকৃত মোচড় নেই, কিন্তু যুক্তির সাবলীল তীক্ষ্ণতা, ধৈর্য্য আর বিশ্লেষণ আছে। যেখানে কাহিনীর শেষে গোয়েন্দা সবাই কে নিয়ে একটা হলঘরে জমায়েত হয়ে বাক্যবাণ আর নাটকীয়তার আতিশয্যে যবনিকাপাত ঘটান না। যেখানে গোয়েন্দা বলেন, "কোনো খুনই সুপারন্যাচারাল নয়"। যেখানে গোয়েন্দা ভিড়ের মাঝে মিশে থাকা আর পাঁচজন মানুষের একজন প্রতিনিধি যাঁকে দেখলে লোকে রিপোর্টার ভেবে ভুল করেন। (Highly recommended) পুনশ্চ - '৩৩ নং আসামি' নামের কানাইচরণ এর একটি কাহিনী আছে যা এই ২টি বইয়ে নেই, আপাতত সেটার হদিশ চাইলাম।
শীর্ষেন্দুকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কেন তথাকথিত গোয়েন্দা গল্প লেখেন না। তার উত্তরে বলেছিলেন, ব্যাপারটা অবাস্তব কারন একজন প্রসাশনের বাইরে থাকা লোকের খবরদারি পুলিশ কেন মেনে নেবে। এ একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। অথচ পপুলার গোয়েন্দা গল্পগুলিতে প্রায়ই দেখা যায় সাধারণ একজন গোয়েন্দা যিনি পুলিশে চাকরী করেন না তাঁকে পুলিশ বেশ সমীহ করছে ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটু তলিয়ে দেখলে মনে হবে এ তো বালখিল্য ব্যাপার। তবে গল্পের জোরে সেগুলি উৎরে যেত। গল্পের জোর থাকলে মানুষ এইসব নিয়ে বেশি ভাবে না। এর উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্ররা স্মরণীয়। আজকার আবার আসল পুলিশি তদন্তের গল্প খুবই জনপ্রিয়। সুপ্রতিম সরকার ও দারোগার দপ্তর বেশ জনপ্রিয়। কারন হয়ত শীর্ষেন্দুর ওই কথাগুলি।
এইরকমই প্রায় বাস্তব গোয়েন্দা কানাইচরণ। নাম সেকেলে হলেও একেবারে হালের গোয়েন্দা তিনি। চাকরি করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরে। এই দপ্তর এক সময়ে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সাথে তূলনীয় ছিল। নানা জটিল কেসের সমাধান হয়েছে। সুপ্রতিম সরকার যার অসামান্য প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। দু মলাটে যেগুলি এখন পাওয়া যায় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে।
কানাইচরণের তিনটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এই বইটি। এর মধ্যে একটি আবার হইচইতে ওয়েব সিরিজ হিসেবে এখন দেখাচ্ছে। আমি বইটি হাতে পাওয়ার আগেই ওয়েব সিরিজটি দেখি। "চড়াই হত্যা রহস্য" পড়তে তাই একটু দ্বিধা বোধ করছিলাম কারণ পরিণতি জানা ছিল বলে। কিন্তু গল্পটি আমার পড়তেই বেশি ভালো লাগল। এছাড়াও আছে "কালাপানির দিশা" যা এক ঐতিহাসিক ঘটনার তদন্ত এইসময়ে বসে। এর চেয়ে বেশি বললে স্পয়লার হয়ে যাবে। আর আছে "পাইস হোটেলে হত্যা" অভিনব সিরিয়াল কিলার নিয়ে। টানটান উত্তেজনা ও পাঠকে ধরে রাখার এক অদ্ভূত রসায়ন।
যাঁরা গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালোবাসেন তাঁরা এই বই খুঁজে পড়বেন। আমি আমার এক আসল পুলিশ বন্ধুকে পাঠিয়েছি প্রকাশকের মাধ্যমে। এখনও ফিডব্যাক পাইনি। অপেক্ষায় আছি।
রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের "পাইয়া ফিরিঙ্গি ডর" বইটার কথা জানতে পারি ফেসবুক থেকে। গুডরিডস-এ খুঁজতে গিয়ে দেখি রাজর্ষিবাবু গোয়েন্দা গল্পও লিখেছেন, নাম "কলকাতা নুয়া" (Kolkata Noir), গোয়েন্দা কানাইচরণের কাহিনী।
"কলকাতা নুয়া" সার্থকনামা নয়। বইয়ের তিনটি বড়গল্পের কোনোটিই "noir" পদবাচ্য নয়; তিনটি গল্পই হলো ইংরেজিতে যাকে বলে "police procedural" (যা গোয়েন্দা-অধ্যুষিত বাংলা সাহিত্যে বিরল)-এর মোড়কে গোলাগুলি ও প্রায় রক্তপাত-বর্জিত, বিংশ শতাব্দীর "Golden Age Mystery" সুলভ গল্প, এবং প্রত্যেকটি রহস্যই বেশ অভিনব। Police procedural হলেও রহস্যগুলি সাধারণ দৈনন্দিন ক্রাইমের আওতায় পড়ে না, বরং বহু গোল্ডেন এজ মিস্ট্রির মতোই বেশ অবাস্তব ও outlandish, যদিও গোল্ডেন এজ মিস্ট্রির একনিষ্ঠ ভক্ত হিসাবে আমার ভালোই লাগলো। সাদামাটা দৈনন্দিন ক্রাইমের গল্প পড়ার জন্য তো খবরের কাগজই রয়েছে।
প্রথম গল্প ("কালাপানির দিশা") একটি ব্রিটিশ আমলের কোল্ড কেসের সমাধান নিয়ে (a la "The Daughter of Time"): ১৯১১ সালে এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে নিয়ে আন্দামানের উদ্দেশ্যে রওনা হয় একটি জাহাজ, ও মাঝসমুদ্রে উধাও হয়ে যায়। আধুনিক সময়ে বসে পুরোনো ফাইল, ম্যাপ, ইত্যাদি ঘেঁটে করা সমাধানটি অদ্ভুত ও চিত্তাকর্ষক। সমাধানের একটা জায়গায় একটু লীপ অব ফেইথের প্রয়োজন আছে, তবে বাঘা-বাঘা লিখিয়ের গোয়েন্দাকাহিনীতেও সেটুকু থাকে; ওটুকু মার্জনা করা যায়। (৭/১০)
দ্বিতীয় গল্পটি ("পাইস হোটেলে হত্যা") বইটির দুর্বলতম। এটি একটি অভিনব সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প, যার মোটিভ, খুনের ধরণ, ও সমাধান তিনটিই অদ্ভুত; আমি অন্তত এরকম সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প কোথাও পড়িনি। পুরো সমাধানটাই বেশ সুন্দর মনস্তাত্বিক যুক্তিসম্বলিত, কেবল খুনিকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায় সামান্য গোঁজামিল রয়েছে মনে হলো। আরো একটি ব্যাপার (যেটা লেখক বইয়ের গোড়ায় নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনে স্বীকারও করেছেন), সেটা হলো একটি বিষের রসায়নে মোক্ষম ভুল, যা আগাথা ক্রিস্টির গুণমুগ্ধ প্রাক্তন রসায়নবিদ পাঠকের চোখে বড্ডো লাগলো । (৬/১০)
তৃতীয় গল্পটি ("চড়াই হত্যা রহস্য") বইয়ের শ্রেষ্ঠ গল্প, এবং আমার পড়া বিগত বেশ কয়েক বছরের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা গল্প (টপ ফাইভ তো বটেই), যেকোনো ভাষায়। এটিও একটি সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প, এবং এরকম অদ্ভুত সিরিয়াল কিলিংয়ের গল্প যে এর আগে কোনো লেখক লেখেননি, এ বিষয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। তদন্ত প্রক্রিয়া, কিলার প্রোফাইলিং, ও শেষে সমাধান, সব মিলিয়ে "চড়াই হত্যা রহস্য" is a masterclass in police procedurals। ইতিহাসের একটা অদ্ভুত অধ্যায় নিয়ে কিছুদিন আগে পড়ার কল্যাণে খুনির প্রোফাইলের একটা বিশেষ দিক উন্মোচিত হতেই খুনির মোটিভ সম্বন্ধে হালকা আভাস পেয়েছিলাম; সেটা শেষে মিলে যাওয়ায় যারপরনাই মজা পেয়েছি। এই গল্পেও একটা ছোট্ট বিষয়ে রিসার্চের অভাব টের পেলাম: নয়ের দশকের শেষ দিকে ইডেনে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট খেলিয়ে দিয়েছেন রাজর্ষিবাবু। গল্পের ওপর এর কোনো প্রভাব নেই, কিন্তু তাও... যাইহোক, সেদিন দেখলাম হৈচৈ নাকি এই গল্পটা নিয়ে সিরিজ বানাচ্ছে; গল্পটা পড়ার পর এমন একটা গল্পের কী পরিণতি হতে চলেছে হৈচৈয়ের হাতে পরে, তা ভেবে বেশ মুষড়ে পড়লাম। (৮/১০)
সবশেষে বলতেই হয় গোয়েন্দা চরিত্রটির কথা। কানাইচরণ সহজাত প্রতিভাধর শখের গোয়েন্দা নন, যিনি চোখ-ধাঁধানো সব ডিডাকশন দিয়ে পাঠককে চমকে দেবেন, তিনি নিছকই একজন সাধারণ মানুষ যিনি পুলিশের চাকরির পরীক্ষা পাশ করে গোয়েন্দা হয়েছেন, নিজের ভাষায় "ল্যাদাভোদা" বলে বিশেষ পদোন্নতির মুখ দেখেননি, ও এখন প্রায় রিটায়ারমেন্টের দোরগোড়ায়; তাঁকে দেখেও গোয়েন্দা বলে মনে হয় না। ভায়োলেন্স পছন্দ করেন না, অফিসের টেবিলে বসে ভাতঘুম দিতে ভালোবাসেন, জুনিয়রের ঘাড় ভেঙে লাঞ্চটা-সিগারেটটা খেয়েই থাকেন, আর সপ্তাহান্তে সিসিল বারে বসে কিঞ্চিৎ এসি ব্ল্যাক পান করে রিলাক্স করেন। তবে কাজের সময় স্রেফ "order and method"-এর সঙ্গে মনস্তত্ব মিশিয়ে যেভাবে তিনটি কেস দাঁড় করলেন, মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এক বেলজিয়ান ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ছিলো। আশা করবো গত শতাব্দীর এই বেলজিয়ান প্রাক্তন-পুলিশকর্তার মতো অবসরের পরেও কানাইচরণের কীর্তিকলাপ বজায় থাকবে।
গোয়েন্দা কানাইচরণ এর গল্প অনেকদিন ধরেই পড়বো পড়বো করছিলাম। অবশেষে এই সিরিজ এর প্রথম বইটা পড়েই ফেললাম। কানাইচরণের আত্মপ্রকাশ এই বইতেই। এই বইতে আছে মোট তিনটি গল্প।
1️⃣. কালাপানির দিশা - ৩/৫ সাসপেন্ড অবস্থায় কানাইচরণ সময় কাটানোর জন্য লালবাজারে বসে পুরোনো কেস ফাইল পড়ছে।একদিন তার হাতে আসে ইতিহাসের একটা কেস, জাহাজ নিখোঁজের। এটা একটা কোল্ড কেস, যার রহস্য কোনোদিন সমাধান হয়নি। একদিনে বসে কেস সল্ভ করাটা অবাস্তব লেগেছে। তাছাড়া পুলিশ একটা কোল্ড কেস এর জন্য এত তৎপর হবে? তবে এটাকে কেস এর সমাধান না বলে একটা কল্পিত থিসিস বলা যেতে পারে। থিসিস এর যুক্তি যদিও দুর্বল মনে হয়েছে তবে লেখকের গল্প বলার ধরনে এটা উতরে গেছে। একজন ডাবল এজেন্ট হয়ে জাহাজে গিয়ে সবাইকে মেরে, একজনকে নিয়ে পালাবে, তাও সে জাহাজ চালাতে জানে না। এছাড়া ভৌগোলিক detailing আছে weather নিয়ে, যা একটু বেশি লেগেছে সাধারণ পাঠক হিসেবে। Slow burn thriller যাদের পছন্দ তাদের ভালো লাগবে।
2️⃣.পাইস হোটেলে হত্যা - ৩.৫/৫ শহরের পাইস হোটেল এ পরপর মৃত্যু হচ্ছে কিছু লোকের। কিন্তু কেন? নতুন কোনও সিরিয়াল কিলিং? না এর সাথে জুড়ে আছে অন্য কিছু? এই গল্পের রহস্য বা তার সমাধান এর কৌশল বেশ ভালো লেগেছে, এনগেজিং বেশ । তবে শেষে এসে সব সহজে বুঝে ফেলা, কানাইচরণ এর একদম পারফেক্ট intution কেমন যেন লাগলো।
3️⃣.চড়াই হত্যা রহস্য - ৩.৫/৫ এটা সবচেয়ে বড় গল্প, বা নভেলা বলা চলে। কানাইচরণ তার সাথীদের কাছে তার ক্যারিয়ার এর শুরুর দিকের একটা কেস এর স্মৃতিচারণ করছে। বিভিন্ন গ্রাম এ মেরে ফেলা হচ্ছে কিছু চড়াইপাখি কে। কে এই সিরিয়াল কিলার? আর কেনই বা মারছে? লেখক এর সাথে তুলে ধ��েছে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিক। তবে এই মোটিভটা আমার জমেনি বা আমার অতটা ইন্টারেস্টিং লাগেনি। কিন্তু গোটা গল্প জুড়ে রহস্যের বুনন, তার সমাধান- গোয়েন্দাগিরির একদম অথেন্টিক স্বাদ পাঠক পাবে। এই গল্প নিয়ে বাংলায় একটা সিরিজ হয়েছে “ব্যাধ” নামে।
👎যা ভালো লাগেনি- 🔹 কানাইচরণ এর intution ১০০% সঠিক, এটা যেন তাকে superhuman বানিয়ে দিয়েছে । 🔹 মাঝে মাঝে অত্যধিক টেকনিক্যালিটি, যা সেই বিষয়ের এক্সপার্ট ছাড়া সাধারণ পাঠকের বোরিং লাগবে ।
👉 আমার ব্যক্তিগত ভাবে স্লো বার্ন থ্রিলার খুব পছন্দ নয়, তাই এই বইটা শেষ করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে। তবে যারা স্লো বার্ন থ্রিলার ভালোবাসেন তারা পড়ে দেখুন । বাংলা থ্রিলার genre এ এই ধরনের কাজ দরকার । এই সিরিজ এর পরের বইটা পড়ে দেখার ইচ্ছা আছে।
জলপাইগুড়ি বইমেলায় হঠাৎ করেই এই বইটার দিকে নজর চলে যায় কোনও একটি স্টলে। জানিনা কেন ইচ্ছে করল পড়ে দেখি কেমন। ভুল সিদ্ধান্ত যে নিইনি, তা প্রমাণ হল পড়তে শুরু করার পর। গোয়েন্দা গল্প পড়তে কার না ভালো লাগে! আর আজকাল তো গোয়েন্দার ছড়াছড়ি। কিন্তু হাজার ডিটেক্টিভের ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে গোয়েন্দা কানাইচরণ এর নাম।
দুটি বড়গল্প আর একটি উপন্যাসিকা সম্বলিত এই বই। পড়তে একবার শুরু করলে, ছাড়তে পারবেন না। গোগ্রাসে গিলতেই হবে। রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের লেখনী অসাধারণ। এত পরিণত, এত পলিশড - আজকালকার লেখকদের থেকে মাইলযোজন এগিয়ে।
আর গোয়েন্দা কানাইচরণ? তার আছে ফেলুদার মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শার্লকের মত ড্ৰাই হিউমার, শবরের মত রেলা আর ব্যোমকেশের মত নিপাট বাঙালিয়ানা। দুঃখ লাগলো জেনে লালবাজারে তার রিটায়ারমেন্ট আসন্ন। অবসরগ্রহণের আগে পাঠককুলকে তিনি আরও রহস্য উপহার দেবেন আশা করি। আর কেনই বা তাকে ক্লোজ করা হয়েছিল, সেই অতীত নিয়েও যদি একখান গল্প হত, আহা! জমে যেত!
বাংলা গোয়েন্দা গল্প যাদের পড়তে ভালো লাগে, অবশ্যই পড়বেন 'কলকাতা নুয়া'। নিরাশ হবেন না।